পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি, সম্প্রীতি ও নিরাপত্তা জোরদারে রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী অঙ্গীকার জরুরি
পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থায়ী শান্তি, সম্প্রীতি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা কেবল একটি আঞ্চলিক অগ্রাধিকার নয়, বরং এটি একটি জাতীয় অপরিহার্যতা। আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক দলগুলোকে তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে পার্বত্য অঞ্চল নিয়ে সুনির্দিষ্ট, নীতিনির্ভর ও কৌশলগত প্রতিশ্রুতি প্রদান করতে হবে।
রোববার (২১ ডিসেম্বর) সকালে চট্টগ্রামের বায়েজিদস্থ সাউদার্ন ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত ‘পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি, সম্প্রীতি ও নিরাপত্তা জোরদারে রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী অঙ্গীকার’ শীর্ষক আঞ্চলিক সংলাপে বক্তারা এসব কথা বলেন। চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওন্যাল স্টাডিজ বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি) এই সংলাপের আয়োজন করে।
সিসিআরএসবিডির চেয়ারম্যান লিয়াকত আলী চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের সভাপতি ও সিসিআরএসবিডির নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. মাহফুজ পারভেজ। সিসিআরএসবিডির পরিচালক অধ্যাপক সরওয়ার জাহানের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে প্যানেল আলোচক ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মো. এনায়েত উল্যা পাটওয়ারী, সিনিয়র সাংবাদিক কবি ওমর কায়সার এবং মং রাজা মংপ্রু সাইন বাহাদুর ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান কুমার সুইচিংপ্রু সাইন।
মূল প্রবন্ধে অধ্যাপক ড. মাহফুজ পারভেজ বলেন, “জাতিগত বৈচিত্র্য ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের অন্যতম সংবেদনশীল অঞ্চল। ১৯৯৭ সালের শান্তিচুক্তি সত্ত্বেও ভূমি বিরোধ, প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ ও আন্তঃসাম্প্রদায়িক আস্থার সংকটের মতো বেশ কিছু অমীমাংসিত সমস্যা এখনো টেকসই শান্তিকে বাধাগ্রস্ত করছে। রাজনৈতিক দলগুলো সাধারণত তাদের ইশতেহারে এই বিষয়গুলোতে অস্পষ্ট থাকে। এখন সময় এসেছে বুদ্ধিবৃত্তিক স্বচ্ছতা ও দূরদৃষ্টির মাধ্যমে এই অঞ্চলের নিরাপত্তা ও উন্নয়নের দায়িত্ব সংজ্ঞায়িত করার।”
অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় চাকসু কেন্দ্রের পরিচালক অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জাহেদুর রহমান চৌধুরী এবং সংলাপের সারসংক্ষেপ তুলে ধরেন চবির আইকিউএসির পরিচালক অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মোশারেফ হোসেন। এছাড়া আরও বক্তব্য রাখেন সাউদার্ন ইউনিভার্সিটির ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য ড. শরীফ আশাফউজ্জামান এবং ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শাহ মুহাম্মদ সুলতান ইকবাল প্রমুখ।
সংলাপে পার্বত্য চট্টগ্রামের বর্তমান পরিস্থিতি ও ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় রাজনৈতিক নেতৃত্বের সদিচ্ছা ও কার্যকর নীতি গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা বিশেষভাবে ফুটে ওঠে। এতে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, গবেষক ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেন।
সংলাপে বক্তারা আরও বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোকে নির্বাচনী বক্তব্যের সীমা অতিক্রম করে জাতীয় ঐক্য সুদৃঢ়করণ এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের প্রসারে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে হবে। তারা পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি বজায় রাখতে ভূমি ব্যবস্থাপনা আধুনিকায়ন এবং গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা শক্তিশালী করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। প্রবন্ধে এই অঞ্চলের স্থায়ী শান্তির লক্ষ্যে ১৫টি সুনির্দিষ্ট সুপারিশমালা উপস্থাপন করা হয়।
১. শান্তিচুক্তির স্পর্শকাতর ও পরস্পরবিরোধী ধারা খ—২৪ এবং ঘ—১৭ ধারা পুনর্মূল্যায়ন করে নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য সেনাক্যাম্প বহাল রাখা এবং ও পুলিশের নিয়োগে পাহাড়ি—বাঙালি সমতায়ন।
২. ভূমি কমিশন আইন সংশোধন করে সিদ্ধান্ত গ্রহণে চেয়ারম্যানের একক ক্ষমতার স্থলে কমিশনের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সিদ্ধান্ত প্রতিস্থাপনপূর্বক গণতন্ত্রায়ন করা।
৩. ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির আগে সঠিক জরিপের মাধ্যমে সরকারি খাস, বসবাসকারী বাঙালি ও পাহাড়িদের জমি শনাক্তকরণের কাজ সম্পন্ন করা।
৪. আঞ্চলিক ও জেলা পরিষদ সমূহের নির্বাচন ৫ বছর পর পর করার আইন থাকলেও তা অদ্যাবধি বাস্তবায়িত হয়নি। বিধান নির্বাচনের মাধ্যমে জনমতের ভিত্তিতে গণতান্ত্রিক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করা।
৫. বাঙালি ও পাহাড়ি উভয় গোষ্ঠীর আভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু সঠিক তথ্যের ভিত্তিতে চিহ্নিত করা।
৬. বৈষম্য দূরীকরণে ও পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে চাকরি এবং উচ্চশিক্ষায় কোটা-ট্যাক্স বৈষম্য, ব্যবসা ও লাইসেন্স ফি, জমিক্রয় বৈষম্য দূর করা।
৭. সন্ত্রাস, অপহরণ, চাঁদাবাজি, অস্ত্র—মানব—মাদক পাচারে নিয়োজিত সন্ত্রাসী গোষ্ঠীসমূহের বিরুদ্ধে সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিরোধ গড়তে সক্রিয় উদ্যোগ গ্রহণ করা।
৮. সংখ্যা—সাম্যের ভিত্তিতে বিভিন্ন পদ বণ্টন ও উন্নয়ন বরাদ্দের ক্ষেত্রে সামঞ্জস্য বিধান করা।
৯. দেশি—বিদেশি প্ররোচণায় বিচ্ছিন্নতাবাদী ও সন্ত্রাসী কার্যক্রম প্রতিরোধের জন্য রাজনৈতিক সামাজিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা করা।
১০. গোষ্ঠীবাদী—বিচ্ছিন্নতাবাদী রাজনৈতিক মনোভাব ত্যাগ করে সব রাজনৈতিক দল ও নেতাদের পক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি, সম্প্রীতি ও নিরাপত্তা জোরদারে সুস্পষ্ট নির্বাচনি অঙ্গীকার প্রকাশ ও তা বাস্তবায়ন করার দৃশ্যমান পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
১১. সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও গোষ্ঠীগত উত্তেজনা প্রশমনে দল ও নেতাদের রাজনৈতিক উদ্যোগ সংলাপ, আলাপ—আলোচনার মাধ্যমে সক্রিয় হওয়া।
১২. পার্বত্য চট্টগ্রামের নানামুখী সমস্যাকে সামরিক দিকে ঠেলে দেওয়ার প্রবণতা ত্যাগ করে দল ও নেতৃত্বকে রাজনৈতিক সমাধানের জন্য আন্তরিকতা ও দক্ষতায় সব সংস্থা ও জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করা।
১৩. শান্তি, সম্প্রীতি ও উন্নয়নের প্রতি বিরোধিতামূলক মনোভাবাপন্ন দল ও নেতাদের রাজনৈতিক অংশগ্রহণ বন্ধ করার জন্য স্থানীয় প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশনকে সক্রিয় ভূমিকা পালন করা।
১৪. সীমান্তে অনুপ্রবেশ ও নাশকতা রোধে নজরদারি বাড়ানোর ক্ষেত্রে রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে তথ্য আদান—প্রদান ও সমন্বয় করার মাধ্যমে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করা।
১৫. আর্থিক উন্নতি, মানবসম্পদ বিকাশ, দক্ষতামূলক প্রশিক্ষণ, পর্যটন, হোটেল ম্যানেজমেন্ট খাতকে এগিয়ে নিতে দল ও নেতাদের পক্ষে বিদ্বেষী মনোভাব ত্যাগ করে সহযোগিতামূলক অবস্থান।




Comments