Image description

“দেইখা লন, বাইছা লন- দাম মাত্র ২০ টাকা, ৩০ টাকা!” শীতের তীব্রতা বাড়ার সাথে সাথে নীলফামারীর সৈয়দপুরে রেললাইনের ধারে অবস্থিত ‘লন্ডন বাজার’ এখন এমনই হাকডাকে সরগরম। উত্তরের ‘গুলিস্তান’ কিংবা ‘ফুটপাত প্লাজা’ নামে পরিচিত এই অস্থায়ী বাজারে এখন মানুষের উপচে পড়া ভিড়। আশ্চর্যের বিষয় হলো, স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকা আস্ত একটি রেলগাড়িও যেন পরিণত হয়েছে একটি লম্বা বাজারে; ট্রেনের জানলা আর দরজায় থাক থাক করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে হরেক রকম শীতবস্ত্র।

সৈয়দপুর শহরের রেললাইন ঘেঁষে গড়ে ওঠা এই অস্থায়ী বাজারটি প্রায় আধা কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত। নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের শীতের কাপড়ের চাহিদা মেটাতে প্রতি বছরের মতো এবারও এখানে প্রায় পাঁচ শতাধিক দোকান বসেছে। স্থানীয়দের পাশাপাশি উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ক্রেতারা এখানে ভিড় জমাচ্ছেন। বিক্রেতাদের তথ্যমতে, এই বাজারে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৫০ লাখ টাকার পুরাতন কাপড় বিক্রি হচ্ছে।

সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত চলা এই বাজারে শীতের কাপড় ২০ টাকা থেকে শুরু করে ২ হাজার টাকা পর্যন্ত দামে পাওয়া যাচ্ছে। ছোট শিশুদের গেঞ্জি ও সোয়েটার ২০ থেকে ৫০ টাকা, বড়দের সোয়েটার ও জ্যাকেট ৮০ থেকে ৩০০ টাকা এবং মেয়েদের বিভিন্ন শীতের পোশাক ৭০ থেকে ৫০০ টাকার মধ্যে বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া উন্নতমানের জ্যাকেট ও সোয়েটার ৫শ থেকে ২ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হতে দেখা গেছে। অনেক হকারকে ‘একটার সাথে একটা ফ্রি’ অফার দিয়েও ক্রেতা আকর্ষণ করতে দেখা যায়।

সরেজমিনে সোমবার (২২ ডিসেম্বর) উত্তরের এই বিশাল পুরাতন কাপড়ের বাজার ঘুরে দেখা গেছে, রেলঘুন্টি থেকে শুরু করে রেলওয়ে স্টেশন প্ল্যাটফর্ম পর্যন্ত সারি সারি অস্থায়ী দোকান বসেছে। মৌসুমি বিক্রেতারা চট্টগ্রাম থেকে পুরাতন কাপড়ের ‘বেল’ পাইকারি কিনে এনে এখানে খুচরা বিক্রি করেন।

কাপড় কিনতে আসা রানীবন্দরের কাউসার জানান, “বাজারে নতুন কাপড়ের যা দাম, তাতে আমাদের মতো মানুষের ভরসা এই ফুটপাত। বাচ্চাদের জন্য ১২০ টাকায় ৪টি শীতের কাপড় কিনেছি। গত বছরের তুলনায় দাম একটু বেশি মনে হচ্ছে, তবে বাজারের তুলনায় অনেক কম।” গোলাহাটের ক্রেতা সাবিয়া আক্তার বলেন, “যে টাকায় বড় মার্কেটে একটি কাপড় পাওয়া যায়, সেই টাকায় এখান থেকে ৭-৮টি কাপড় কেনা সম্ভব।”

তবে এবার দাম নিয়ে কিছুটা অসন্তোষ রয়েছে বিক্রেতাদের মাঝেও। বিক্রেতা শাহজাদা, নুরু ও ইউসুফ জানান, গত বছর যে ‘বেবি বেল’ ৩-৫ হাজার টাকায় কেনা যেত, এবার তা ৭-৯ হাজারে কিনতে হচ্ছে। জ্যাকেট বেল ১০ হাজার থেকে বেড়ে ১৮ হাজার এবং কম্বল ১২ হাজার থেকে ৩২ হাজার টাকা পর্যন্ত দরে মহাজনদের কাছ থেকে সংগ্রহ করতে হচ্ছে। মূলত তাইওয়ান, জাপান ও কোরিয়া থেকে আমদানিকৃত এসব কাপড়ের বেলের দাম এ বছর চট্টগ্রাম আড়তেই আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে খুচরা বিক্রিতেও এর প্রভাব পড়ছে।

পুরাতন কাপড় ব্যবসায়ী মো. শমসের খান বলেন, “পরিবহন খরচ ও আমদানিকৃত বেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় এবার ব্যবসার পুঁজিতে টান পড়ছে। চট্টগ্রাম থেকে একেকটি বেল আনতে গত বছরের চেয়ে এবার গড়ে ৩-৪ হাজার টাকা বেশি খরচ হচ্ছে।”

বাজারটি জমে উঠলেও রেললাইনের একদম পাশেই ঝুঁকিপূর্ণভাবে দোকান বসানোয় যেকোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনার আশঙ্কা করছেন সচেতন মহল। প্রতিদিন শত শত ট্রেন ও ইঞ্জিন চলাচলের মাঝেই ঝুঁকি নিয়ে চলছে এই জমজমাট কেনাবেচা। তবে ঝুঁকি আর বাড়তি দামের মধ্যেও শীত নিবারণের জন্য দরিদ্র মানুষের একমাত্র নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে টিকে আছে এই ‘লন্ডন বাজার’।