সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সেই শেষ ‘গর্জন’: ২০১৭ সালের জনসমাবেশে কী বলেছিলেন খালেদা জিয়া
বাংলাদেশের রাজনীতির ‘আপসহীন নেত্রী’ হিসেবে পরিচিত বেগম খালেদা জিয়া মঙ্গলবার (৩০ ডিসেম্বর) শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছেন। তাঁর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে অবসান হলো এক দীর্ঘ ও বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক পরিক্রমার। তবে তাঁর এই বর্ণিল রাজনৈতিক জীবনে ২০১৭ সালের ১২ নভেম্বর ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসভাটি এক অবিস্মরণীয় এবং ঐতিহাসিক অধ্যায় হয়ে থাকবে। সেটিই ছিল জনসমক্ষে সশরীরে উপস্থিত হয়ে খালেদা জিয়ার দেওয়া শেষ কোনো ‘জ্বালাময়ী’ ভাষণ।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনের পর থেকে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার খালেদা জিয়া ও তাঁর দল বিএনপিকে জনসভা করার ক্ষেত্রে কঠোর বাধার মুখে ফেলেছিল। প্রশাসনের নানা শর্ত আর নিষেধাজ্ঞার কারণে টানা তিন বছর তিনি কোনো প্রকাশ্য সমাবেশে অংশ নিতে পারেননি। সেই দীর্ঘ নীরবতা ভেঙে ২০১৭ সালের ১২ নভেম্বর জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস উপলক্ষে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আয়োজিত জনসভায় যোগ দেন তিনি। এটি ছিল স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে তাঁর এক দাপুটে প্রত্যাবর্তন।
দুপুর পৌনে ২টায় সমাবেশ শুরু হলেও খালেদা জিয়া মঞ্চে ওঠেন বেলা ৩টার দিকে। লাখো মানুষের উপস্থিতিতে কানায় কানায় পূর্ণ উদ্যানে দাঁড়িয়ে তিনি এক ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। তাঁর ভাষণের মূল বিষয় ছিল গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন।
সেদিন তিনি সরাসরি ঘোষণা করেছিলেন, “আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে কোনো সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়।” তিনি শেখ হাসিনার সরকারকে ‘একদলীয় শাসনের’ জন্য অভিযুক্ত করে নির্বাচনের সময় সেনাবাহিনী মোতায়েন এবং নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি তোলেন। তাঁর সেই কঠোর ও আপসহীন অবস্থান তৎকালীন শাসকগোষ্ঠীকে প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ করেছিল।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ওই বিশাল সমাবেশের পর শাসক দল ও প্রশাসনের পক্ষ থেকে খালেদা জিয়ার ওপর অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা আরও কঠোর করা হয়। সেই সমাবেশের মাত্র তিন মাসের মাথায় ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া এতিমখানা ট্রাস্ট মামলায় তাঁকে কারারুদ্ধ করা হয়। এরপর দীর্ঘ কারাবাস, গৃহবন্দিত্ব এবং বার্ধক্যজনিত অসুস্থতার কারণে তিনি আর কখনো সশরীরে কোনো জনসভায় অংশ নিতে পারেননি। মাঝখানে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর ৭ আগস্ট তিনি একটি ভার্চুয়াল সভায় বক্তব্য দিলেও, ২০১৭ সালের ওই দিনটিই ছিল রাজপথে তাঁর শেষ বলিষ্ঠ উপস্থিতি।
দীর্ঘ ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে দমন-পীড়ন ও রাজনৈতিক একাকিত্বের শিকার হওয়া এই নেত্রী শেষ পর্যন্ত রাজপথের সেই উত্তাল দিনগুলোর স্মৃতি নিয়েই চলে গেলেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ২০১৭ সালের সেই জনসভাটি ছিল খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সাহসিকতার শেষ প্রকাশ্য মহড়া। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে সেই দিনটি কেবল একটি জনসভা হিসেবে নয়, বরং গণতন্ত্রের জন্য এক জননেত্রীর শেষ ‘রণহুঙ্কার’ হিসেবে স্মৃতির পাতায় অক্ষয় হয়ে থাকবে।
মানবকন্ঠ/আরআই




Comments