Image description

আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক এমপি ওয়াকিল উদ্দিন এবং বিএনপির সাবেক কাউন্সিলর এম এ কাইয়ূমের ব্যবসায়িক সখ্যতার কথা বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশ পেলে দিশেহারা কাইয়ূম উঠে পরে লেগেছেন গণমাধ্যমের পেছনে। দিয়ে যাচ্ছেন মিথ্যা মামলা ও হামলার হুমকি। কাইয়ূম-ওয়াকিলের সম্মিলিত ব্যবসায়িক দায়িত্বের পালাবদলের মত সংসদীয় আসনের রদবদলের দিবা স্বপ্নে বিভোর এখন তিনি। 

গণঅভ্যুত্থানে পতিত স্বৈরাচার হাসিনার এমপি ওয়াকিলের আসনেই (ঢাকা-১১) নাকি বিএনপি থেকে মনোনয়ন নেবেন নিউমার্কেটে এক সময়ের গামছা বিক্রেতা এম এ কাইয়ূম। স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন- এ যেন মামা বাড়ির আবদার। চতুর কাইয়ূমও বিষয়টি আঁচ করতে পারছেন। তাই টেকনাফের ইয়াবা সম্রাট বদীকে অনুসরণ করে বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের কারণে বিএনপি থেকে মনোনয়ন বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কায় স্ত্রীকে মাঠে নামিয়েছেন বিএনপি নেতা সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর এম এ কাইয়ূমের হাতে কোম্পানির মালিকানা হস্তান্তর ঘিরে শুরু হয়েছে তুমুল আলোচনা। যেখানে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী দুই শিবিরের নেতা অর্থ ও ব্যবসার ভাগাভাগিতে এক হয়ে যান- সেই অন্ধকার বাস্তবতাই নতুন করে সামনে নিয়ে এসেছে স্বদেশ প্রপার্টিজের কর্মকাণ্ড। 

২০০৩ সালে নিবন্ধিত স্বদেশ প্রপার্টিজের সূচনালগ্নে ওয়াকিল উদ্দিন ছিলেন ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি)। তার দুই ছেলে ফরসাদ উদ্দিন ও রিয়াসাদ উদ্দিন পরিচালক হিসেবে যুক্ত হন। কিন্তু ওয়াকিল উদ্দিনের বিরুদ্ধে গণহত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগে একাধিক মামলা চলমান। তিনি বর্তমানে আত্মগোপনে রয়েছেন। তবুও, কোম্পানির ২০ লাখ শেয়ারের মধ্যে প্রায় ১০ লাখ শেয়ার এখনো ওয়াকিল উদ্দিন ও তার পরিবারের নামে রয়েছে। অর্থাৎ, পালিয়ে থেকেও তিনি কোম্পানির আর্থিক সুবিধাভোগী হতে পারেন- এমন শঙ্কাই জোরালো হয়েছে।

কাইয়ূমের অন্ধকার অধ্যায়: অভিযোগ রয়েছে, কাইয়ূম এবং ওয়াকিল স্বর্ণালী স্বদেশ প্রকল্পে অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল আকবর হোসেন, ব্রিগেডিয়ার (অব) মেফতাহ, জেনারেল (অব) সাইদ মাসুদকে নিয়ে দেশি-বিদেশি অনেক মানুষ হত্যা করে। ইতালির নাগরিক হত্যাসহ আরও অনেক খুনের পর তাদের লাশ স্বদেশ স্বর্ণালী প্রকল্পের বালুর নিচে পুঁতে রাখা হয়। তারপর আশিয়ান গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ গ্রুপের অন্যদের নামে মামলা দায়ের করা হয় কাইয়ূম-ওয়াকিলের নেতৃত্বে। অথচ ওই সময় অশিয়ানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক দেশেই ছিলেন না।

আয়নাঘর সাজানোর প্রথম অধিনায়কও ছিলেন তারা। ব্রিগেডিয়ার মেফতাহ, জেনারেল সাইদ মাসুদসহ কাইয়ূমের সতীর্থরাই আয়নাঘর বানানোর নেতৃত্ব দিয়েছে। ওয়াকিল, কাইয়ূম, মেফতাহ প্রতিদিনই মিটিং করতো কাকে কাকে ধরে আনা যায় এবং নির্যাতন করা যায়। কাইয়ূম, ওয়াকিল, আকবর, মেফতাহরাই ছিল আয়নাঘরের মূল পরিকল্পক। সরকারের উপদেষ্টারা তাদের ধরে আইনের আওতায় এনে জিজ্ঞাসাবাদ করলেই সব তথ্য বেরিয়ে আসবে। গুম, হত্যার জন্য কেন তারা আয়নাঘর তৈরি করেছে তা পরিষ্কার হয়ে যাবে। বাংলাদেশে আরও যত আয়নাঘর আছে তাও বের হয়ে আসবে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করলে।

কাইয়ূম ছিলেন গুদারাঘাটের চাঁদাবাজ। আর ওয়াকিল বসুন্ধরার দালাল ছিলেন। খুনি ও আয়নাঘরের পরিকল্পক হয়েও তারা এখন নির্বিঘ্নে অন্যান্য ব্যবসায়ীদের হয়রানি করছে। কাইয়ূম ও ওয়াকিলের পরিকল্পনাতেই আশিয়ান গ্রুপের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম ভূঁইয়াকে প্রথমে আয়নাঘরে নেয়া হয়। ৫ আগস্টের পর থেকে তারা অনেক ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষের নামেও মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করছেন। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাসহ সরকারের উপদেষ্টাদের কাছে এর সঠিক বিচার প্রত্যাশা করেন তারা।  

কাইয়ূমের উত্থান ও মালিকানা হাতবদল: গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী সরকারের পতনের পর মালিকানা পরিবর্তনের প্রক্রিয়া শুরু হয়। যৌথ মূলধনি কোম্পানি ও ফার্মসমূহের পরিদপ্তরের (আরজেএসসি) নথি অনুযায়ী, সেপ্টেম্বর  মাসে মালিকানা পরিবর্তনের আবেদন দাখিল করা হয়। যদিও স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সময় ১ জুলাই ২০২৪ থেকেই প্রস্তুতি নেয়া শুরু করে কাইয়ূম। যাতে স্পষ্ট দেখা যায় গণঅভ্যুত্থানের আগ থেকেই কাইয়ূম ওয়াকিলের ঘনিষ্ঠতার প্রমাণ। 

আলোচিত স্বর্ণ চোরাচালানকারী মনির হোসেনের (গোল্ডেন মনির) কাছ থেকে স্বদেশ প্রপার্টিজের (রেজিস্ট্রেশন নং সি-৪৮৩২২) চার কোটি ২০ লাখ টাকার শেয়ার কিনে নেন কাইয়ূম। স্মাগলার গোল্ডেন মনির ও কাইয়ূমের দহরম মহরম সবারই জানা। তাদের মধ্যকার ব্যবসায়িক মালিকানার হাত বদলে যা স্পষ্টত প্রতীয়মান।

বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী একটি গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, এম এ কাইয়ূমের সাথে গণহত্যার দায়ে অভিযুক্ত ফ্যাসিস্ট সাবেক কোনো এমপির ব্যবসায়িক সম্পর্ক থাকলে দলীয় ফোরামে উত্থাপন করে তার ব্যবস্থা নিবেন। সেখানে বিএনপির সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর এম এ কাইয়ূম, আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি ওয়াকিল উদ্দিন ও সোনা চোরাকারবারি গোল্ডেন মনিরের ব্যবসায়িক সম্পর্কের দালিলিক প্রমাণ থাকায় যেকোনো সময় কাইয়ূমের বিরুদ্ধে বিএনপি থেকে কঠোর সিদ্ধান্ত আসতে পারে বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।

জমি দখলের অভিযোগ: রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) একাধিকবার নোটিশ দিয়ে জানিয়েছে, স্বদেশ প্রপার্টিজ সরকারি খাস জমি ও ফ্লাড ফ্লো জোনের জমি দখল করে অবৈধ প্রকল্প চালাচ্ছে। রাজউকের নির্দেশে কার্যক্রম বন্ধ হওয়ার কথা থাকলেও, নতুন মালিকানা আসার পরও কোম্পানির প্রকল্পগুলো সচল রয়েছে। 

স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, কোম্পানির প্রভাবশালী মালিকরা গুলশান, বাড্ডা ও রামপুরা এলাকায় দখলবাজি ও ভয়ভীতি প্রদর্শন করে আসছেন। একজন ক্ষতিগ্রস্ত বাসিন্দা জানান, তারা রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে জমি দখল করেছে। রাজউকের নোটিশ কাগজেই থেকে যায়, মাঠে বাস্তবায়ন হয় না। তিনি জানান, স্বর্ণালী প্রকল্পে জোর করে বালু ভরাট করা হয় আওয়ামী লীগ আমলে। ভুয়া মিউটেশন দলিল তৈরি করে রাজউক থেকে মিথ্যা কাগজপত্র তৈরি করে নেয়।

রাজনৈতিক আঁতাত: প্রতিদ্বন্দ্বিতা নয়, স্বার্থসন্ধি- যদিও ওয়াকিল উদ্দিন আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা ছিলেন এবং এম এ কাইয়ূম বিএনপির সাবেক কাউন্সিলর, বাস্তবে তাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়িক সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। কাইয়ূমের অতীত রেকর্ড বলছে, তিনি একাধিকবার আওয়ামী লীগের ছায়াতলে আশ্রয় নিয়েছেন। সাবেক আওয়ামী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের বাবা মনসুর আলী হাসপাতালের দেখভালের দায়িত্ব পান কাইয়ূম, বিনিময়ে মাসে মাসে মোটা অংকের মাশোহারা গুনেন তিনি বলে নিশ্চিত করেছে একাধিক সূত্র। 

গণমাধ্যমে একাধিকবার তার আওয়ামী লীগ ঘনিষ্ঠতার কার্যক্রম প্রকাশিত হয়েছে। সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দেয়ার হুমকি দিয়ে তিনি আলোচিত হয়েছেন। বিভিন্ন গণমাধ্যমে তার বিএনপিবিরোধী কার্যকলাপ ও নানা দুর্নীতি অপকর্মের ফিরিস্তি প্রকাশ পেলে কাইয়ূম হামলা-মামলার পথ বেছে নিয়ে নিজের দৈন্যদশা প্রকাশ করেন। বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজনৈতিকভাবে প্রতিদ্বন্দ্বী হলেও লুটপাটের প্রশ্নে কাইয়ূম ও ওয়াকিল দুজনের পথ মিলে গেছে।

জনমনে প্রশ্ন ও আশঙ্কা: রাজনৈতিক দল পরিবর্তন, গোপন আঁতাত ও জমি দখলের অভিযোগে সাধারণ মানুষের মধ্যে স্বদেশ প্রপার্টিজ নিয়ে তীব্র ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। একইসাথে প্রশ্ন উঠেছে- ওয়াকিল উদ্দিন আত্মগোপনে থেকেও কীভাবে একটি কোম্পানির মালিকানা ধরে রাখেন এবং রাজউকের নোটিশ অমান্য হয় কীভাবে? স্বদেশ প্রপার্টিজের মালিকানা পরিবর্তন শুধু একটি কোম্পানির ব্যবসায়িক লেনদেন নয়, বরং রাজনৈতিক আঁতাত, জনবিরোধী আওয়ামী লীগের অর্থনৈতিক ক্ষমতা ধরে রাখা, আর জমি দখলের মতো ভয়াবহ অনিয়মের বহিঃপ্রকাশ। 

কাইয়ূম এর আওয়ামী-প্রীতির একাধিক প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও তাকে কেন বহিষ্কার করছে না বিএনপি সে প্রশ্ন তুলছে বিএনপির বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মী-সমর্থকরা। গণহত্যাকারী আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি ওয়াকিলের সাথে যৌথ ব্যবসায় জড়িত কাইয়ূমের বিরুদ্ধে যে কোনো সময় ব্যবস্থা নিতে পারে বিএনপি, যা নিশ্চিত করেছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের একাধিক সিনিয়র নেতৃবৃন্দ।

নগর গবেষক আতিকুল ইসলাম বলেন, রাজনীতিতে যারা প্রকাশ্যে শত্রু, ব্যবসায় তারা সহযোগী। জনগণের সম্পদ লুট করাই এদের আসল লক্ষ্য। আবাসন খাতের বড় বড় প্রকল্প আসলে প্রভাবশালীদের লুটপাটের ক্ষেত্র।