Image description

ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার শুক নদীর বুড়ির বাঁধে চলছে ঐতিহ্যবাহী মাছ ধরার উৎসব। প্রতি বছরের মতো এবারও হাজারো মানুষ এই উৎসবে মেতে উঠেছেন। গত শুক্রবার সন্ধ্যায় বাঁধের গেট খোলার পর থেকে শুরু হয় মাছ ধরার ধুম। শনিবার ও রোববার সকাল থেকে রাত পর্যন্ত জালের ছপছপ শব্দে মুখরিত ছিল গোটা বুড়ির বাঁধ এলাকা।

প্রতি বছর এই সময়ে বুড়ির বাঁধে মাছ ধরার উৎসব একটি মেলায় রূপ নেয়। বিভিন্ন এলাকা থেকে আগত মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে মাছ ধরায় অংশ নিচ্ছেন। পলো, চাবিজাল, খেয়াজাল, টানাজাল, ছেঁকাজাল হাতে নিয়ে অনেকে কাঁদার মধ্যে মাছ খুঁজছেন। যাদের হাতে মাছ ধরার সরঞ্জাম নেই, তারাও খালি হাতে মাছ ধরার চেষ্টায় মগ্ন। বাঁধের পাড়ে ভিড় জমিয়েছেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ, যা গ্রাম-বাংলার চিরচেনা ঐতিহ্যের স্মৃতি জাগিয়ে তোলে।

স্থানীয় স্কুল শিক্ষক রফিকুল ইসলাম বলেন, “ভোর থেকে মাছ ধরতে এসেছি। মূলত আনন্দ-উল্লাসের জন্য প্রতিবার আসি। আজ রোববার সকাল থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত মাছ ধরেছি। পুঁটি, ষোল, শিংসহ প্রায় তিন কেজি দেশি মাছ পেয়েছি।”

বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত্বাবধানে ১৯৫১-৫২ সালে শুষ্ক মৌসুমে কৃষি জমির সেচ সুবিধার জন্য বুড়ির বাঁধে একটি জলকপাট নির্মাণ করা হয়। এই জলকপাটে আটকে থাকা পানিতে মৎস্য অধিদপ্তর প্রতি বছর বিভিন্ন জাতের মাছের পোনা ছাড়ে। আকচা ও চিলারং ইউনিয়ন পরিষদ এই পোনার দেখভাল করে। বাঁধের সামনে একটি অভয়াশ্রম রয়েছে, যেখানে মাছ ধরা নিষিদ্ধ। মৎস্য বিভাগ এ বিষয়ে তৎপর থাকলেও স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রশাসনের অবহেলা ও সমন্বয়হীনতার কারণে মাছ ধরার এই ঐতিহ্য কিছুটা বিঘ্নিত হচ্ছে।

বেগুনবাড়ি থেকে আসা মনোয়ার হোসেন ও আফজাল হোসেন বলেন, “প্রতিবার এখানে মাছ ধরতে আসি। অনেক মানুষ মিলে মাছ ধরতে ভালো লাগে। এটা এখন একটা মেলায় পরিণত হয়েছে।” তবে বালীয়াডাঙ্গী উপজেলার চাড়োল গ্রামের রথিন্দ্র ও যতি মোহন জানান, “গতবার অনেক মাছ পেয়েছিলাম, কিন্তু এবার তেমন মাছ পাওয়া যাচ্ছে না। রিং জালের ব্যবহারে মাছ কমে গেছে।” গত দুই-তিন বছর ধরে মাছের পরিমাণ কমে যাওয়ায় জেলে, মৎস্যজীবী ও মৎস্যপ্রেমীরা হতাশা প্রকাশ করেছেন।

ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা আয়েশা আক্তার বলেন, “প্রতি বছরের মতো এবারও মাছ ধরার উৎসব শুরু হয়েছে। অভয়াশ্রমে যাতে কেউ মাছ না ধরে, সে বিষয়ে আমরা তৎপর। মৎস্য অধিদপ্তর প্রতি বছর বুড়ির বাঁধে মাছের পোনা ছাড়ে, যাতে এই ঐতিহ্য ধরে রাখা যায়।”

বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপসহকারী কর্মকর্তা কৃষিবিদ রাফিউল বারী জানান, “বুড়ির বাঁধ সেচ প্রকল্পটি ১৯৫১-৫২ সালে নির্মিত। গেট খোলার পর এখানে মানুষের সমাগম ঘটে এবং আমিষের চাহিদা পূরণ হয়।”

স্থানীয়দের অভিযোগ, জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের অবহেলা এবং ভালো দেখাশোনার অভাবে মাছের পরিমাণ কমে যাচ্ছে। এ বিষয়ে ঠাকুরগাঁও জেলা প্রশাসক ইশরাত ফারজানা বলেন, “মাছ ধরার উৎসবটি ঐতিহ্যবাহী ও সার্বজনীন। অবহেলা বা দায়িত্বহীনতা নয়, তবে কিছুটা সমন্বয়হীনতার সমস্যা রয়েছে। একাধিক পরিষদ ও মানুষের সম্পৃক্ততার কারণে এই সমস্যা হচ্ছে। তবে দেশি জাতের মাছের চাষ ও অভয়াশ্রম প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সকলের সহযোগিতায় বুড়ির বাঁধের পুরোনো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনা হবে।”

বুড়ির বাঁধে মাছ ধরার এই উৎসব শুধু আমিষের চাহিদা পূরণই নয়, বরং গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্য ও সামাজিক বন্ধনকে আরও মজবুত করে। মৎস্য অধিদপ্তর, উপজেলা প্রশাসন ও স্থানীয়দের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এই ঐতিহ্য ধরে রাখার প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়েছে।