সুনামগঞ্জের ধোপাজান নদে লুট হচ্ছে কোটি টাকার সিলিকা বালু: প্রশাসনের নীরবতা নিয়ে প্রশ্ন
সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুর ও সদর উপজেলার সীমান্তঘেঁষা প্রাকৃতিক সম্পদ, পাথর মিশ্রিত সিলিকা বালুর প্রধান উৎস, ৩৭১ একর বিশিষ্ট ধোপাজান নদের বালুমহালে ড্রেজারে বালু উত্তোলনের বিরুদ্ধে আদালতের নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের বালু-পাথর মহালটি একটি কোম্পানিকে এক বছরের জন্য 'বিধি বহির্ভূত' ইজারা দিয়েছে বিআইডব্লিউটিএ সিলেট আঞ্চলিক দফতর। লিমপিড ইঞ্জিনিয়ারিং নামের ওই কোম্পানি গত ১১ অক্টোবর থেকে রাতে প্রায় অর্ধশত ড্রেজারের মাধ্যমে কৌশলে কোটি কোটি টাকার সিলিকা বালু লুট করে নিচ্ছে। এ পর্যন্ত প্রায় ২৮ কোটি ৫০ লাখ টাকার বালু লুট করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
জানা যায়, বিআইডব্লিউটিএ কোম্পানিটিকে নির্ধারিত এলাকা থেকে দিনে একবার ভিট মাটি উত্তোলনের অনুমোদন দিলেও, কর্মকর্তারাদের 'ম্যানেজ' করে কোম্পানিটি স্থানীয় বালু লুটকারীদের দিয়ে রাতে মূল্যবান খনিজ বালু উত্তোলন করছে। এতে নদী তীরবর্তী গ্রামগুলো হুমকির মুখে পড়েছে এবং নদীর ওপর নির্ভরশীল প্রায় ২০ হাজার বারকি শ্রমিক জীবিকা হারানোর আশঙ্কায় রয়েছেন। স্থানীয় বারকি শ্রমিক, নদী তীরবর্তী মানুষ ও পরিবেশ আন্দোলনের কর্মীরা গত ১৩ অক্টোবর বিশ্বম্ভরপুরের পিয়ালপুর বেড়িবাঁধে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ করায় তাদের হুমকি-ধমকি দেওয়া হচ্ছে বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে।
সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসন ও পরিবেশ আন্দোলনের নেতাকর্মী সূত্রে জানা গেছে, অতীতে ইজারাদাররা সনাতন পদ্ধতির বদলে ড্রেজারে বালু লুট করায় পরিবেশ আন্দোলন 'বেলা' ২০১২ সালে একটি মামলা দায়ের করে। তখন আদালত ড্রেজার নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। কিন্তু ইজারাদার আবারও ড্রেজার ব্যবহার করায় 'বেলা' ২০১৪ সালে আদালত অবমাননার (মামলা নং ২২৪) মামলা করে। এদিকে পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা এবং নদের দুই পাড়ের মানুষের জীবন ও সম্পদ রক্ষায় সরকার ২০১৮ সাল থেকে ধোপাজান বালু-পাথর মহাল ইজারা বন্ধ রেখেছে। এতে চলতি অর্থ বছর পর্যন্ত প্রায় হাজার কোটি টাকা রাজস্ব বঞ্চিত হচ্ছে সরকার।
সম্প্রতি খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের বালু ও পাথর মহালটি গোপনে লিমপিড ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানিকে ভিট মাটি উত্তোলনের 'বিধি বহির্ভূত' অনুমতি দিয়েছে বিআইডব্লিউটিএ। গত ১১ অক্টোবর থেকে রাতে অন্তত ৫০টি ড্রেজারের মাধ্যমে মাটির বদলে বালু উত্তোলন করে নদীটিকে বিপন্ন করে ফেলা হচ্ছে। প্রতি রাতে ড্রেজারে প্রায় ২ লাখ ৫০ হাজার ফুট বালু লুট করা হচ্ছে, যার বাজার মূল্য আনুমানিক ১ কোটি ৭৫ লাখ টাকা।
সরেজমিনে নদীতে গিয়ে দেখা গেছে, অক্ষয়নগর থেকে ডলুরা পর্যন্ত নদীর দুই তীরে রাতে ড্রেজারে বালু লুট করা হচ্ছে। দিনেও ড্রেজারে মাটির বদলে বালু উত্তোলন চলছে। এই বালু কার্গো ও বাল্কহেড নৌকায় তুলে সুনামগঞ্জ শহরের ওয়াজখালী, জলিলপুর, জয়নগরসহ বিভিন্ন স্থানে স্তূপ করে ঢাকাসহ সারাদেশে কার্গোতে প্রকাশ্যে বিক্রি করা হচ্ছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, বিআইডব্লিউটিএর দুর্নীতিবাজ চক্র মোটা অঙ্কের সুবিধা পেয়ে সিলিকা বালু লুটের সুযোগ করে দিয়েছে।
এ ঘটনায় স্থানীয় এলাকাবাসী, নদীর ওপর নির্ভরশীল বারকি শ্রমিক ও পরিবেশ আন্দোলনের নেতাকর্মীরা ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন। নদীটিতে বালু মজুদের পরিমাণ নিয়ে কোনো গবেষণা না করেই অনুমোদন দেওয়ায় এটিকে প্রচলিত আইনের লঙ্ঘন বলে মনে করেন পরিবেশবিদরা।
জানা গেছে, গত ১৬ জুলাই বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) সিলেট আঞ্চলিক দফতর লিমপিড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ব্যবস্থাপনা অংশীদার মুজাহিদুল ইসলাম মুরাদকে ধোপাজান নদী থেকে ভিট মাটি উত্তোলনে লিখিত অনুমোদন দেয়। সিলেট-ঢাকা সড়কে মাটির জন্য মাত্র ৬৬ লাখ ৭৬ হাজার ৯৪২ টাকায় রাজস্ব ধার্য্য করে এক কোটি ২১ লাখ ঘনফুট বালু তোলার অনুমতি দিয়েছে বিআইডব্লিউটিএ। অথচ তারা এক রাতেই ১ কোটি ৭৫ লাখ টাকার বালু লুট করে নিচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চলতি অর্থ বছরে তাহিরপুর, ধর্মপাশা, জামালগঞ্জ ও সুনামগঞ্জের একাধিক নৌঘাট ইজারা নেয় একটি চক্র। তারাই বিআইডব্লিউটিএকে রিজার্ভ ধোপাজান নদীটি ইজারা দিতে প্রস্তাব দেয় এবং মোটা অঙ্কের ঘুষ প্রদান করে। গত ২২ জুন আবেদনের পর ৯ জুলাই অনুমোদন দেয় বিআইডব্লিউটিএ।
বিআইডব্লিউটিএর দুর্নীতিবাজ চক্রকে ম্যানেজ করে বালু লুটকারীরা এলাকার নাম উল্লেখ না করে কৌশলে বিশাল মৌজার কথা উল্লেখ করে ড্রেজারে নদীর বালু লুটের কৌশল নেয়। অনুমতিপত্রে দেখা গেছে, নির্ধারিত এলাকায় বিকেল ৫টার পর ভিট বালু উত্তোলনে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও রাতেই ড্রেজারে বালু লুট করছে তারা। ভিট মাটি ঢাকা-সিলেট সড়কে ব্যবহার করার কথা থাকলেও সড়কে ব্যবহার না করে বাল্কহেড ও কার্গোতে সারাদেশে বিক্রি করা হচ্ছে।
আরও জানা গেছে, বিআইডব্লিউটিএ এবং ইজারাদার বালু লুটে সহযোগিতা নেয় আওয়ামী লীগ সরকারের সময় 'বালুখেকো' হিসেবে পরিচিত নদীর দুই পাড়ের স্থানীয় একাধিক চক্রের, যাদের সাথে কিছু প্রভাবশালী বিভিন্ন দলের ব্যক্তি জড়িত। তারাই ড্রেজার মেশিন লাগিয়ে রাতে নদীটি থেকে বালু লুট করছে।
সরেজমিন এলাকায় গিয়ে জানা গেছে, ধোপাজান নদী তীরবর্তী গ্রামের মানিক মিয়া, উড়ারকান্দা গ্রামের মনা, রমজান আলী ও জাকির হোসেন, মণিপুরী হাটির আল আমিন, জায়েদ আলী, বাবুল, কাইয়ারগাঁও গ্রামের মকবুল, লালপুর গ্রামের মমিন, বাদাঘাটের সুমন, অমল, ইকবাল ও সাজু মিয়াসহ জেলা শহরের আরো কয়েকজন প্রভাবশালী ড্রেজারে বালু লুট করছে।
স্থানীয়রা জানান, ধোপাজান নদীটি থেকে ভিটা বালু তোলার অনুমতি বাতিলের দাবিতে জেলা প্রশাসন গত ২৪ আগস্ট চিঠি দিয়েছে। জেলা বালুমহাল ব্যবস্থাপনা কমিটির অনুমতি ছাড়াই বিধি বহির্ভূত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে বলে ওই পত্রে মন্তব্য করা হয়। তাছাড়া নদীটিতে পাথর মিশ্রিত সিলিকা বালু বলেও উল্লেখ করা হয়। তাই বিআইডব্লিউটিএর অনুমতির ফলে সরকার বিপুল রাজস্ব হারানোর পাশাপাশি আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিরও অবনতির আশঙ্কার কথা জানানো হয় জেলা প্রশাসনের পত্রে। ওই পত্রটি নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবকে পাঠানো হয়েছিল।
এদিকে প্রশাসন রাতের আঁধারে বালু লুটে ব্যবস্থা না নেওয়ায় স্থানীয় শ্রমিক ও পরিবেশ আন্দোলনের কর্মীরা গত শুক্রবার রাতে উড়ারকান্দা পুলিশ ফাঁড়ির কাছে বালু ভর্তি একাধিক বাল্কহেড আটক করেন। আটক নৌকা ছাড়িয়ে নিতে ক্যাডার দিয়ে স্থানীয়দের হুমকি-ধমকি দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
বারকি শ্রমিক নেতা হাফিজুর রহমান বলেন, "আমরা দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানাচ্ছি ধোপাজান নদীটি ইজারা দিয়ে পরিবেশসম্মত সনাতন উপায়ে বালু-পাথর আহরণের জন্য। কিন্তু আমাদের দাবি না মেনে সরকার ইজারা বন্ধ রেখে এখন বিধি বহির্ভূতভাবে বিআইডব্লিউটিএ নদীতে ভিট মাটি তোলার কথা বলে খনিজ মন্ত্রণালয়ের কোয়ারি থেকে সিলিকা বালু লুটের অনুমতি দিয়েছে।"
সুনামগঞ্জ পরিবেশ আন্দোলনের সাংগঠনিক সম্পাদক শাহীনুল ইসলাম বলেন, "ইতিমধ্যে প্রায় ২৮ কোটি টাকার সিলিকা বালু লুট করে নিয়েছে চক্রটি। মোটা অঙ্কের সুবিধা নিয়েছে বিআইডব্লিউটিএর দুর্নীতিবাজ চক্র। বিধি বহির্ভূত এই অনুমোদন আদালত অবমাননার শামিল। কারণ নদীতে ড্রেজার না চালানোর জন্য আদালতের নিষেধাজ্ঞা আছে। এই চুক্তি বাতিল না হলে নদীটির স্বাভাবিক ভারসাম্য ধ্বংস হয়ে যাবে ও দুই পাড়ের সাধারণ মানুষের জীবনে বিপর্যয় নেমে আসবে। সরকারও হাজার কোটি টাকার রাজস্ব হারাবে।"
এদিকে গত ২৯ অক্টোবর জেলা এনসিপি, জুলাই যোদ্ধা ও বিপুল সংখ্যক সাধারণ মানুষ সুনামগঞ্জ ট্রাফিক পয়েন্টে ধোপাজান নদসহ সারা জেলার বিভিন্ন নদনদীর বালু-পাথর ও খনিজ সম্পদ লুটপাটের বিরুদ্ধে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ করে।
এ বিষয়ে সুনামগঞ্জ জেলা এনসিপির যুগ্ম সমন্বয়ক আতাউর রহমান স্বপন বলেন, "এনসিপি সুনামগঞ্জের নদনদী, হাওর ও পাহাড় নিয়ে যে বিশাল প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে তার যথাযথ ব্যবস্থাপনার দাবি জানায় ও সকল অন্যায়, অনিয়মের বিরুদ্ধে সবসময় সোচ্চার রয়েছে।"
সুনামগঞ্জ জেলা জাতীয়তাবাদী তাঁতি দলের সাবেক সভাপতি ও সমাজকর্মী মনিরুল ইসলাম বলেন, "ধোপাজান নদের বালু লুটপাটে একদিকে সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে ও অন্যদিকে অনিয়মতান্ত্রিকভাবে সিলিকা বালু উত্তোলনে পরিবেশের ভারসাম্য ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আমরা এর আশু সমাধান চাই।"
লিমপিড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের কর্মকর্তা রাশেদ আলম বলেন, "মাটি এবং বালু উত্তোলনের জন্য আমাদের অনুমতি দিয়েছে সরকার। আমরা এ পর্যন্ত তিনদিন বালু তুলে সিলেট-ঢাকা সড়কের কাজের জন্য স্তূপ করছি।" রাতে ড্রেজারে বালু উত্তোলনের নিষেধাজ্ঞা থাকলেও কেন তোলা হচ্ছে সে বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, "আমরা যখন তখন তুলতে পারবো।" পরে আবার তিনি বলেন, "রাতে যারা বালু তুলছে তারা আমাদের কেউ না।"
সুনামগঞ্জের পুলিশ সুপার আ ফ ম আনোয়ার হোসেন খান বলেন, "চলতি নদীতে নিয়মবর্হিভূত বালু-পাথর উত্তোলন সম্পূর্ণ অবৈধ। যারা এসব অবৈধ কাজে যুক্ত, তাদের বিরুদ্ধে পুলিশ ব্যবস্থা নিচ্ছে। পুলিশের বিরুদ্ধে একটি পক্ষ অপপ্রচার চালাচ্ছে। তবে যদি পুলিশের কেউ জড়িত থাকেন, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।"
জেলা প্রশাসক ড. মোহাম্মদ ইলিয়াস মিয়া গণমাধ্যমকে বলেন, খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের বালু মিশ্রিত পাথর মহালের বিআইডব্লিউটিএর অনুমতি বাতিলের জন্য স্থানীয়দের একাধিক স্মারকলিপি ও প্রতিবাদ কর্মসূচির বিষয়টি আমি যথাযথ কর্তৃপক্ষকে অবগত করেছি। এছাড়াও রাতে ড্রেজারে বালু উত্তোলন করলে অভিযানও চালাচ্ছি। এই মহালটি সিলিকা বালু মহাল হিসেবে গেজেটভুক্ত।
এ বিষয়ে বিআইডব্লিউটিএ সিলেটের সহকারী পরিচালক শরিফুল ইসলামের মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি।




Comments