
চুয়াডাঙ্গার জীবননগরে ভুট্টা চাষ করে অনেক কৃষকের ভাগ্য বদলে গেছে। এর ফলে গ্রামীণ অর্থনীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। একসময় এই অঞ্চলের কৃষিকাজ শুধু ইরি-বোরো ধান, আমন ধান এবং কিছু চিরাচরিত শাকসবজির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু বর্তমানে আধুনিক পদ্ধতিতে ভুট্টা চাষ করে কৃষকরা প্রচুর অর্থ উপার্জন করছেন। ভুট্টা চাষের এই সাফল্য কৃষকদের মুখে হাসি ফুটিয়েছে এবং এটি এখন তাদের কাছে খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। চলতি মৌসুমে উপজেলায় রেকর্ড পরিমাণ জমিতে ভুট্টা চাষ করা হয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ আশা করছে, বড় কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে ভুট্টার বাম্পার ফলন হবে।
উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, চলতি মৌসুমে উপজেলায় ৬ হাজার ১২০ হেক্টর জমিতে ভুট্টার চাষ করা হয়েছে।
কৃষকরা জানিয়েছেন, ভুট্টা চাষে খরচ বাদে প্রতি বিঘা জমিতে ২৫-৩০ হাজার টাকা লাভ থাকে। বছরে দুবার ভুট্টা চাষ করা যায়। নভেম্বর-ডিসেম্বর এবং মে-জুন ভুট্টা চাষের জন্য উপযুক্ত সময়। শীতকালে ফলন বেশি হওয়ায় কৃষকরা এই সময়ে বেশি চাষাবাদ করেন।
তাঁরা আরও জানান, একই জমিতে ধান চাষ করে গড়ে ২৫-৩০ মণ ফলন পাওয়া যায়, যার বাজারমূল্য ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা। অন্যদিকে, ভুট্টা চাষ করে ৪০-৪৫ মণ ফলন পাওয়া যায়, যার বাজারমূল্য কমপক্ষে ৫০ হাজার টাকা। এই কারণেই কৃষকরা ধানের চাষ কমিয়ে ভুট্টার দিকে ঝুঁকছেন। গত বছর ভুট্টার ভালো দাম পাওয়ায় এ অঞ্চলের কৃষকরা উচ্চ ফলনশীল জাতের ভুট্টা চাষে আগ্রহী হয়েছেন।
জীবননগর উপজেলার আন্দুলবাড়িয়া গ্রামের ভুট্টা চাষি আবদার হোসেন জানান, ২০ বছর আগে তিনি প্রথম এই এলাকায় ভুট্টা চাষ শুরু করেন। প্রথম বছর এক বিঘা জমিতে ৩ হাজার টাকা খরচ করে উৎপাদিত ভুট্টা প্রায় ১৫ হাজার টাকায় বিক্রি করেন। এতে লাভ বেশি হওয়ায় তিনি পরের বছর জমির পরিমাণ আরও বাড়ান। এ বছর তিনি ৪ বিঘা জমিতে ভুট্টা চাষ করেছেন এবং আশা করছেন উৎপাদিত ভুট্টা প্রায় ২ লক্ষ টাকায় বিক্রি করতে পারবেন।
তিনি আরও জানান, কার্তিকের শেষে জমি ভালোভাবে কর্ষণ করে সার প্রয়োগের মাধ্যমে ভুট্টা চাষের উপযোগী করা হয়। বীজ বপনের ১০-১৫ দিনের মধ্যে চারা গজায় এবং ৬ মাসের মধ্যে ভুট্টা সংগ্রহ করা যায়। প্রতি বিঘা জমিতে ৪০-৪৫ মণ ভুট্টা উৎপাদিত হয়। জমি তৈরি থেকে ভুট্টা সংগ্রহ পর্যন্ত প্রতি বিঘা জমিতে ১৫-২০ হাজার টাকা খরচ হয় এবং উৎপাদিত ভুট্টা ৪৫-৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। এতে প্রতি বিঘা জমিতে প্রায় ৩০ হাজার টাকা লাভ হয়।
একতারপুর গ্রামের ভুট্টা চাষি আমিনুল ইসলাম বলেন, ভুট্টা চাষে লাভ বেশি ও নিরাপদ। প্রতি বিঘা জমিতে ২০ হাজার টাকা খরচ হয় এবং ভুট্টা ভালো হলে ৪০-৪৫ হাজার টাকায় বিক্রি করা যায়। দেশি জাতের তুলনায় হাইব্রিড ভুট্টায় সার, কীটনাশক ও সেচের খরচ কম, তাই কৃষকরা হাইব্রিড ভুট্টা চাষে বেশি আগ্রহী। ভুট্টা গাছ ও মাড়াইয়ের পর অবশিষ্ট অংশ জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা যায়।
খয়েরহুদা গ্রামের কৃষক ইউনুস আলী জানান, অন্যান্য ফসলের পাশাপাশি গত বছর ভুট্টা চাষ করে ভালো দাম পাওয়ায় এ বছর তিনি ভুট্টার চাষ বাড়িয়েছেন। ভুট্টার দাম ভালো থাকলে এ বছরও লাভবান হবেন বলে তিনি আশা করছেন।
উথলী গ্রামের ভুট্টা চাষি সামাদুল হক জানান, গত বছর ৩ বিঘা জমিতে ভুট্টা চাষ করে সব খরচ বাদ দিয়ে প্রায় ১ লক্ষ ৩০ হাজার টাকা লাভ হয়েছিল। এ বছর তিনি সাড়ে ৫ বিঘা জমিতে ভুট্টা চাষ করেছেন এবং বড় কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে বাম্পার ফলনের আশা করছেন।
জীবননগর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. আলমগীর হোসেনের মতে, ভুট্টা এই উপজেলার প্রধান অর্থকরী ফসল। এই উপজেলার মাটি ভুট্টা চাষের জন্য খুবই উপযুক্ত এবং কৃষি কর্মকর্তারা নিয়মিত পরামর্শ দেওয়ায় এখানে রেকর্ড পরিমাণ ভুট্টা চাষ হয়েছে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে বলে আশা করা যায়। তবে কৃষকরা যদি ভুট্টা সংরক্ষণ করতে পারতেন, তাহলে তারা আরও বেশি লাভবান হতেন। কৃষি বিভাগ থেকে আধুনিক জাতের ও উচ্চ ফলনশীল ভুট্টার চাষ বাড়ানোর জন্য কৃষকদের প্রদর্শনী ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। এর ফলে ভবিষ্যতে ভুট্টার চাষ আরও বাড়বে বলে আশা করা যায়।
Comments