সিন্ডিকেটের কবলে জেলেদের অধিকার: রাজশাহীতে মৎস্যজীবীদের দুর্দশা

রাজশাহীতে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা বিত্তবানদের সিন্ডিকেট কৌশলে অসহায় জেলেদের অধিকার গ্রাস করছে। সরকারি পুকুর ও বিভিন্ন বরাদ্দ বিত্তশালীদের হাতে চলে যাওয়ায় প্রকৃত জেলেরা বঞ্চিত হচ্ছেন। মৎস্য অধিদপ্তর প্রশাসনিক ক্ষমতার অভাবে এই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হচ্ছে, ফলে অনিয়মগুলো এখন নিয়মে পরিণত হয়েছে।
রাজশাহী জেলায় মোট জেলের সংখ্যা ২০ হাজার ৭০০ জন। এখানে সরকারি পুকুরের সংখ্যা ৫,৯৭৯টি, যার আয়তন ১ হাজার ২৪৮ দশমিক ৪৩ হেক্টর, এবং বেসরকারি পুকুরের সংখ্যা ৬৯ হাজার ৪১০টি, আয়তন ১৮ হাজার ৩৬৩ দশমিক ৯২ হেক্টর। সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে মোট পুকুরের সংখ্যা ৭৫ হাজার ৩৮৯টি এবং আয়তন ১৯ হাজার ৬১২ দশমিক ৭৫ হেক্টর। দেশের মধ্যে মৎস্য চাষে রাজশাহী জেলা চতুর্থ স্থানে রয়েছে। বিশ্বে ইলিশ উৎপাদনে বাংলাদেশ প্রথম এবং সব ধরনের মাছ চাষে পঞ্চম স্থানে অবস্থান করছে। তবে এই সমৃদ্ধির সুফল প্রকৃত জেলেরা ভোগ করতে পারছেন না।
উপজেলাভিত্তিক চিত্র
রাজশাহী জেলার ৯টি উপজেলার মধ্যে পুকুর ও জেলেদের সংখ্যা নিম্নরূপ
পবা: সরকারি পুকুর ৫৮টি, বেসরকারি পুকুর ৯ হাজার ৪৫৪টি, জেলে ৩ হজার ১২ জন।
পুঠিয়া: সরকারি পুকুর ১৯৭টি, বেসরকারি পুকুর ৯ হাজার ৪৯২টি, জেলে ১১ হাজার ৬৩৩ জন।
মোহনপুর: সরকারি পুকুর ৩৫০টি, বেসরকারি পুকুর ৫ হাজার ৬৬৪টি, জেলে ২ হাজার ৮১ জন।
গোদাগাড়ী: সরকারি পুকুর ৩ হাজার ৬৭টি, বেসরকারি পুকুর ১ হাজার ৪১টি, জেলে ২ হাজার ৮৩২ জন।
তানোর: সরকারি পুকুর ৯৫৯টি, বেসরকারি পুকুর ৯ হাজার ২০১টি, জেলে ১ হাজার ৯৮৩ জন।
দুর্গাপুর: সরকারি পুকুর ৩৯০টি, বেসরকারি পুকুর ৮ হাজার ৭২৪টি, জেলে ২ হাজার ১৫১ জন।
বাগমারা: সরকারি পুকুর ৮৮০টি, বেসরকারি পুকুর ১২ হাজার ৫৮৬টি, জেলে ৫ হাজার ২৪ জন।
চারঘাট: সরকারি পুকুর ২৭টি, বেসরকারি পুকুর ৪ হাজার ৪২১টি, জেলে ১ হাজার ১৮৯ জন।
বাঘা: সরকারি পুকুর ৫১টি, বেসরকারি পুকুর ৫ হাজার ৫১৪টি, জেলে ১ হাজার ৩০৫ জন।
সিন্ডিকেটের কৌশল
নিয়ম অনুযায়ী, সরকারি পুকুরগুলো নিবন্ধিত জেলেদের মাছ চাষের জন্য বরাদ্দ দেওয়ার কথা। এই বরাদ্দ প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) অফিস। তবে শাহাপুর মৎস্য সমিতির সভাপতি শাজাহান আলীসহ অনেক জেলে জানিয়েছেন, স্থানীয় বিত্তশালীরা কৌশলে জেলেদের নামে পুকুর বরাদ্দ নিয়ে নিচ্ছেন এবং জেলেদের সামান্য অর্থ দিয়ে বিদায় করছেন। কখনো কখনো রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়েও এই পুকুরগুলো নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে।
ইলিশ প্রজনন মৌসুমে মাছ শিকার বন্ধ থাকায় অসচ্ছল জেলেদের জন্য মৎস্য অধিদপ্তর প্রণোদনা ও খাদ্য সামগ্রী বিতরণ করে। কিন্তু জেলেদের অভিযোগ, এই বরাদ্দও প্রকৃত জেলেদের হাতে পৌঁছায় না। দলীয় নেতারা তাদের স্বজনদের মাধ্যমে এই সুবিধা নিয়ে নিচ্ছেন। এমনকি, অনেক সাধারণ মানুষকে জেলে কার্ড দেওয়া হলেও তারা প্রকৃত জেলে নন।
মৎস্য অধিদপ্তরের অপারগতা
জেলা ও উপজেলা মৎস্য অধিদপ্তর জানায়, সরকারি পুকুরের বরাদ্দ নিয়ে তাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই; এটি উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) অফিসের এখতিয়ার। তবে তারা প্রকৃত জেলেদের সুবিধা দেওয়ার চেষ্টা করলেও প্রশাসনিক ক্ষমতার অভাবে সঠিক সময়ে সিদ্ধান্ত নিতে বিলম্ব হয়। ফলে সিন্ডিকেটের কাছে তারা অপারগ।
প্রশাসনের প্রতিক্রিয়া
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মহিনুল হাসান জানান, ভুক্তভোগী জেলেদের লিখিত অভিযোগ জেলা প্রশাসকের কাছে জমা দিতে হবে। তদন্তের মাধ্যমে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জেলেদের হতাশা
বিভিন্ন উপজেলার জেলেরা জানান, দীর্ঘদিনের এই অনিয়ম এখন নিয়মে পরিণত হয়েছে। তারা এই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কোনো সমাধান দেখছেন না। অনেকে হতাশা প্রকাশ করে বলেন, এই অভ্যাস এখন তাদের জীবনের অংশ হয়ে গেছে।
রাজশাহীর মৎস্য চাষের সম্ভাবনা বিশাল হলেও, সিন্ডিকেটের কারণে প্রকৃত জেলেরা তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এই পরিস্থিতির সমাধানে জেলা প্রশাসন ও মৎস্য অধিদপ্তরের সমন্বিত পদক্ষেপ জরুরি।
Comments