Image description

সাধারণত খেজুরের রস সংগ্রহ ও গুড় তৈরির মৌসুম শুরু হয় শীতকালের নভেম্বর মাসে। এ সময়ে প্রয়োজন হয় অনেক মাটির ভাঁড়ের। শীত মৌসুমকে সামনে রেখে জেলার জীবননগর উপজেলার দেহাটি গ্রামে ব্যস্ত সময় পার করছেন মাটির ভাঁড় তৈরির কারিগর মৃৎশিল্পীরা।

সরেজমিনে দেখা যায়, গ্রামের বিভিন্ন স্থানে ভাঁড় তৈরির কারিগররা (কুমার) এঁটেল মাটি ও পানির মিশ্রণে ভাঁড় তৈরি করছেন। তৈরি ভাঁড়গুলো রোদে শুকানো হচ্ছে, পরে তা পুড়িয়ে রস রাখার উপযোগী করা হয়। আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার ও নকশায় ভাঁড়গুলো আরও আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে।

দেহাটি গ্রামের কুমার নিতাই পাল বলেন, অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত তিন মাস ভাঁড় বানানোর ভরা মৌসুম। প্রতিদিন ৫০ থেকে ৭০টি ভাঁড় তৈরি করতে পারি। রস রাখার ভাঁড় বিক্রি করি ৩০ টাকা করে আর গুড় রাখার ভাঁড় বিক্রি হয় ৪০ টাকায়। তিন মাসে দেড় থেকে দুই লাখ টাকার ভাঁড় বিক্রি করতে পারি। খরচ হয় প্রায় ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা। তিনি আরও জানান, আমাদের তৈরি ভাঁড় কিনতে বিভিন্ন এলাকার গাছিরা পাইকারি ও খুচরা দামে কিনতে আসে। ভাঁড় তৈরি করতে আমাদের এখানে ৫ থেকে ১০ জন শ্রমিক কাজ করে।

শ্রমিক গোপাল বলেন, ভোর ৬টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত কাজ করি। প্রতিদিন হাজিরা পাই ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা। এই কাজ করেই পাঁচ সদস্যের পরিবার নিয়ে ভালো আছি।

আরেক শ্রমিক আনান্দোপাল বলেন, আমি ভাঁড় পোড়ানোর কাজ করি। সন্ধ্যা ৬টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত কাজ করে ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা পর্যন্ত হাজিরা পাই। এই কাজের আয়ে পরিবার নিয়ে সুখে আছি।

অনন্ত কুমার পাল বলেন, জীবননগর উপজেলার এককালের ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প আজ বিলুপ্তির পথে। সভ্যতার এ যুগে মানুষ মাটির তৈরি জিনিসের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলার কারণে অনেক কুমার পরিবার তাদের পৈতৃক পেশা ছেড়ে দেওয়ায় বর্তমানে এখানে মাত্র ২৫ টি কুমার পরিবার কোনোরকমে টিকে আছে। এক সময় জীবননগরের মৃৎশিল্প চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর ও ঝিনাইদহ জেলাসহ আশপাশের অঞ্চলে প্রসিদ্ধ ছিল। কালের আবর্তে মৃৎশিল্পের প্রচলন হ্রাস পাওয়ায় কুমার সম্প্রদায় এ পেশায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। পূর্বপুরুষের আদি পেশায় ধস নামায় উপজেলার দেহাটি, খয়েরহুদা, আন্দুলবাড়িয়া ও মনোহরপুর গ্রামের দু’ শতাধিক নামী দামী মৃৎশিল্পী পরিবার এ পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে গেছেন। সিলভার, প্লাস্টিক ও রাবারের এ যুগে এখনো জীবননগরের ২১ টি পরিবার প্রতিকূল সময়ের সঙ্গে সংগ্রাম করে কোনো রকমে এ পেশায় টিকে রয়েছে।

উত্তম কুমার পাল বলেন, অধিকাংশ মানুষজন প্লাস্টিক ও রাবারের সামগ্রীর দিকে ঝুঁকে পড়েছেন। মাটির তৈরি হাঁড়ি-পাতিলসহ অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ওপর থেকে মানুষ মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। কুমাররা এক সময় মাটি দিয়ে হাঁড়ি-পাতিল-কলস ও থালাসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় অন্যান্য জিনিসপত্র তৈরি করলেও বর্তমানে এসব জিনিসের কদর নেই বললেই চলে। এখন তারা মাটির তৈরি ফুলের টব, বাচ্চাদের খেলনা ও বিভিন্ন ধরনের সৌখিন শিল্পের দ্রব্যাদি তৈরি করে বাজারজাত করছেন।

স্থানীয়রা জানান, ভাঁড় তৈরি করা দেহাটি গ্রামের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী পেশা। খেজুরের রস সংগ্রহের মৌসুম ঘনিয়ে এলে এই পেশায় নতুন করে প্রাণ ফিরে আসে গ্রামজুড়ে।

জীবননগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আল আমীন বলেন, এটি একটি পুরাতন ঐতিহ্য যা কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে। আমাদের উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে যদি কোনো সহযোগিতার সুযোগ থাকে তাহলে আমরা অবশ্যই তাদের পাশে দাঁড়াবো।