Image description

গ্রামীণ অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত সাপ্তাহিক হাটগুলো আজ বিলুপ্তির পথে। একসময় গ্রামবাংলার বাণিজ্য, সামাজিক মিলনমেলা ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতীক ছিল এই হাটগুলো। কিন্তু আধুনিকতার ঢেউয়ে সেই ঐতিহ্য হারিয়ে যাচ্ছে দ্রুত। গাজীপুর মহানগরীর পূবাইল বাজারের সাপ্তাহিক হাট তারই এক জীবন্ত উদাহরণ।

একসময় পূবাইল বাজারের সাপ্তাহিক হাট ছিল আশপাশের বিস্তীর্ণ এলাকার মানুষের বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দু। নদীপথ ও সড়কপথে দূর-দূরান্ত থেকে পণ্যবাহী নৌকা, ট্রলার ও ট্রাক এসে ভিড়ত এই হাটে। দেশীয় ফলমূল, শাকসবজি, বাঁশ-বেতের পণ্য, মাটির হাঁড়ি-কলসি আর নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীতে ভরে থাকত পুরো মাঠ। বিক্রেতা-ক্রেতার ভিড়ে মুখর থাকত এলাকা; এটি শুধু কেনা-বেচার স্থান নয়, ছিল সামাজিক মেলবন্ধনেরও জায়গা।

প্রতি শনিবার ও মঙ্গলবার পূবাইল বাজারে এই হাট বসে। গত শনিবার (২৫ অক্টোবর) সকালে সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, একসময়ের জমজমাট হাট এখন মাঠের এক কোণে সীমাবদ্ধ। কিছু বিক্রেতা বসলেও ক্রেতা হাতে গোনা। নদীর ঘাটে কিংবা সড়কে পণ্যবাহী যানবাহনের আনাগোনা আর আগের মতো নেই। অনেক বিক্রেতাকে অলস বসে থাকতে দেখা গেছে। মঙ্গলবারের হাটের অবস্থা আরও শোচনীয়। স্থানীয়দের ভাষায়, “মঙ্গলবারে হাট বলে এখন কিছুই নেই।”

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গ্রামীণ হাটের পতনের পেছনে রয়েছে আধুনিক জীবনধারা, অবকাঠামোগত পরিবর্তন ও বিপণন ব্যবস্থার রূপান্তর। এখন গ্রামাঞ্চলেও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দোকান সহজলভ্য; ফলে মানুষ নির্দিষ্ট দিনের হাটের জন্য অপেক্ষা করে না। পাশাপাশি অনলাইন মার্কেটের প্রসার, নদীপথে পণ্য পরিবহনের গুরুত্ব কমে যাওয়া এবং নদীভাঙনসহ পরিবহন ব্যাহত হওয়ায় এই হাটগুলো তাদের প্রাণচাঞ্চল্য হারাচ্ছে।

প্রবীণ বাসিন্দা আব্দুল গাফফার বলেন, “এই হাট শুধু বেচা-কেনার জায়গা ছিল না, ছিল মিলনমেলা। দূর-দূরান্তের মানুষ এসে দেখা-সাক্ষাৎ করত। হাটে না এলে মনে হতো সপ্তাহটাই বৃথা। এখন সেই প্রাণ নেই; আধুনিকতার নামে আমরা আমাদের সংস্কৃতি হারাচ্ছি।”

কৃষিপণ্য বিক্রেতা ফেরদৌস মিয়া বলেন, “আগে হাটে এসে ফসলের ভালো দাম পেতাম। এখন ছোট দোকানদার বা পাইকারেরা কম দামে কিনে নেয়। ক্রেতা কমে যাওয়ায় লাভও কমে গেছে। মঙ্গলবারে তো হাটে লোকই থাকে না।”

পূবাইল বাজার কমিটির সাধারণ সম্পাদক এনামুল হক বলেন, “আমরা হাটের ঐতিহ্য ধরে রাখার চেষ্টা করছি। কিন্তু গ্রামের প্রতিদিনের দোকানপাট ও বাজারের প্রসার মানুষের আগ্রহ কমিয়ে দিয়েছে। সরকার যদি কৃষকদের সরাসরি বিক্রির সুযোগ ও হস্তশিল্পের প্রচার বাড়ায়, তাহলে হাটগুলো আবার প্রাণ ফিরে পেতে পারে।”

বিশেষজ্ঞদের মতে, গ্রামীণ হাট শুধু বাণিজ্য নয়, এটি গ্রামীণ সংস্কৃতি ও সামাজিক বন্ধনের প্রতিচ্ছবি। আধুনিকতার প্রবাহে এই ঐতিহ্য হারিয়ে না যায়, সেজন্য দরকার সময়োপযোগী পরিকল্পনা ও সরকারি উদ্যোগ। পূবাইলের সাপ্তাহিক হাট এখনো শনিবারে কিছু মানুষ নিয়ে টিকে আছে, তবে মঙ্গলবারে ক্রেতা-বিক্রেতার আনাগোনা প্রায় নেই। এই ঐতিহ্যবাহী হাটের জৌলুস ফিরিয়ে আনতে প্রয়োজন পরিকল্পিত উদ্যোগ ও সচেতনতা।