Image description

সিরাজগঞ্জের যমুনা নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে পানি কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নতুন নতুন ডুবোচর জেগে উঠেছে। আর এসব চরই সৃষ্টি করেছে ভয়াবহ নাব্যসংকট। নদীপথে নৌযান চলাচল ব্যাহত হচ্ছে, কোথাও নৌকা আটকে যাচ্ছে, আবার কোথাও এক কিলোমিটারের পথ ঘুরে পাঁচ-ছয় কিলোমিটার গিয়ে গন্তব্যে পৌঁছাতে হচ্ছে। ফলে এক ঘণ্টার নদীপথ পার হতে সময় লাগছে দুই থেকে তিন ঘণ্টা। বেড়েছে জ্বালানি ব্যয়—আর সেই অজুহাতে মাঝিরা নৌকা ভাড়া বাড়িয়ে দেওয়ায় যাত্রীদের নাভিশ্বাস উঠে গেছে।

দু-পাড়ের হাজারো মানুষ প্রতিদিন যমুনা নদী পার হয়ে জেলা শহর, উপজেলা প্রশাসন, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও বিভিন্ন কর্মস্থলে যাতায়াত করেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাওয়া-আসা করা ছাত্রছাত্রীর সংখ্যাও নেহাত কম নয়। কিন্তু শুষ্ক মৌসুমে জেগে ওঠা অসংখ্য ডুবোচর এখন তাদের প্রতিদিনকার জীবনের সবচেয়ে বড় বাধা।

মনসুর নগর চরের মমতা কাজিপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা নিতে আসেন প্রায়ই। তারই ভাষায়, “চর ঘুরে কাজিপুরে আসতে দেড় থেকে দুই ঘণ্টা সময় বেশি লাগে। রোগী নিয়ে নৌকা বদলাতে হয়, চর পাড়ি দিতে হয়—ভীষণ কষ্ট।”

মেঘাই ঘাটে সবজি বিক্রি করতে আসা নাটুয়ারপাড়া চরের কৃষক বক্কর জানান, “মেঘাই বাজারে আসতে দুই বার নদী পার হতে হয়। নৌকা ঘুরে আসে, পানি কম থাকলে মাঝ পথে নামতে হয়। তারপর আবার নৌকায় উঠি।”

চরাঞ্চলের স্কুল-কলেজগামী শিক্ষার্থীদের দুর্ভোগ সবচেয়ে বেশি। ছিন্ন চর ও দুলাল চরের শিক্ষার্থী রবিন ও সোনিয়া জানান, “শুষ্ক মৌসুমে নদীতে এত চর উঠে যে সঠিক সময়ে স্কুলে পৌঁছানো খুবই কঠিন। অনেক জলপথ ঘুরে নৌকাগুলো যায়। ভোরে বের হলেও সন্ধ্যার আগে বাড়ি ফেরা যায় না।” তাদের মতে, এই অবস্থার কারণে পাঠচক্র ব্যাহত হচ্ছে, ক্লাস মিস করতে হচ্ছে, বাড়ছে ক্লান্তি ও মানসিক চাপ।

মেছড়া চরের কৃষক ইকবাল প্রতিদিন কৃষিপণ্য নিয়ে সিরাজগঞ্জ শহরে আসেন। কিন্তু নাব্যসংকটের কারণে সে পথ দীর্ঘ হয়ে যায়। তিনি বলেন,  “ভোরে পণ্য নিয়ে রওনা দিলেও অনেক সময় বাজারের বেলা চলে যায়। আগেই পৌঁছাতে না পারায় ন্যায্যমূল্য পাই না।” ফলে কৃষকদের লোকসান গুণতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত।

কাওয়াখোলা চরের রফিক জানান, “ক্যানেলের পানি কমে গিয়ে নৌকা আটকে থাকে প্রায়ই। আবার নির্দিষ্ট সময়ে নৌকা না পেলে শহরে আত্মীয়ের বাসায় থাকতে হয়। অনেক সময় হোটেলেও রাত কাটাতে হয়।”

মনসুর নগর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুর রাজ্জাক  বলেন, “শুষ্ক মৌসুমে নদী শুকিয়ে শাখা-নদীগুলো বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। প্রতি বছরই চরবাসীদের একই দুর্ভোগ পোহাতে হয়। শিক্ষার্থী, রোগী, কর্মজীবী—সবাই সবচেয়ে বেশি ভোগে।”

সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোখলেসুর রহমান জানান,  “নদী খনন ও নাব্যতা রক্ষার কাজ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নয়। এগুলো সম্পূর্ণ বিআইডব্লিউটিএ (বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ)-র আওতাধীন। আমরা শুধু ভাঙন নিয়ন্ত্রণের কাজ দেখি।”

অর্থাৎ যমুনায় নাব্যসংকট নিরসনে দ্রুত পানি প্রবাহ পুনরুদ্ধার, চ্যানেল খনন এবং ডুবোচর অপসারণের ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়ার দায়িত্ব মূলত বিআইডব্লিউটিএর।

যমুনার বুকে ছড়িয়ে থাকা বিস্তীর্ণ চর একদিকে চরাঞ্চলের মানুষের জীবিকায় নতুন সম্ভাবনা তৈরি করলেও নৌপথে যাতায়াতের দুর্ভোগ আজ এক কঠিন বাস্তবতা। কর্মঘণ্টা নষ্ট হওয়া, অতিরিক্ত সময় ও খরচ—সব মিলিয়ে চরবাসীর জীবনযাত্রা যেন থমকে দাঁড়িয়েছে।

স্থানীয়রা বলছেন, নদীর নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে জরুরি ভিত্তিতে খনন কার্যক্রম, নির্দিষ্ট নৌরুট চালু এবং নদী ব্যবস্থাপনায় সমন্বিত উদ্যোগ না নিলে শুষ্ক মৌসুমে এই দুর্ভোগ আরও চরমে উঠবে।