দেশ-বিদেশের বাজারে বাঁশখালীর শুঁটকি: কর্মব্যস্ত উপকূলে হাজারো শ্রমিক
চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার উপকূলীয় এলাকা এখন শুঁটকি উৎপাদনের ধুম পড়েছে। শীত মৌসুমে বঙ্গোপসাগর থেকে আহরিত মাছ রোদে শুকিয়ে প্রক্রিয়াজাত করতে ব্যস্ত সময় পার করছেন জেলেরা। সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক উপায়ে ও বিষমুক্তভাবে উৎপাদিত হওয়ায় এখানকার শুঁটকির কদর বাড়ছে দেশ ও বিদেশের বাজারে।
সরেজমিনে দেখা যায়, উপজেলার জালিয়াখালী নতুন বাজার, শেখেরখীল ও ছনুয়া উপকূলের বিস্তীর্ণ সৈকতজুড়ে গড়ে উঠেছে শুঁটকিপল্লি। রূপালি বালুর চরে বিছানো কালো জাল ও পলিথিনের ওপর সারি সারি শুঁটকি শুকানো হচ্ছে। গত কয়েক বছর ধরে সাগরে জলদস্যুদের দৌরাত্ম্য বাড়লেও জীবন-জীবিকার তাগিদে ঝুঁকি নিয়েই মাছ ধরছেন জেলেরা।
সাধারণত নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত চলে শুঁটকি তৈরির মৌসুম। তবে এবার বর্ষা শেষ হতে না হতেই শুরু হয়েছে কর্মযজ্ঞ। শুঁটকি মহালগুলোতে কাজ করছেন প্রায় ৫ থেকে ৭ হাজার শ্রমিক, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারী ও শিশু। সাগর থেকে মাছ আহরণ, ধোয়া, বাছাই ও শুকানোর কাজে তৈরি হয়েছে বিশাল কর্মসংস্থান।
সংশ্লিষ্টদের মতে, দেশের অনেক এলাকায় শুঁটকি সংরক্ষণে ইউরিয়া সার, লবণ বা বিভিন্ন রাসায়নিক ব্যবহারের অভিযোগ থাকলেও বাঁশখালীর চিত্র ভিন্ন। এখানকার জেলেরা কেবল রোদের তাপেই মাছ শুকিয়ে শুঁটকি তৈরি করেন। ফলে এই শুঁটকি স্বাস্থ্যসম্মত ও সুস্বাদু। এখানকার উৎপাদিত লইট্যা, ছুরি, রূপচাঁদা, ফাইস্যা, মাইট্যা, কোরাল, রইস্যা ও চিংড়ি শুঁটকি চট্টগ্রাম শহরের চাক্তাই, খাতুনগঞ্জ ও চকবাজারের পাইকারি আড়ত হয়ে চলে যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। পাশাপাশি দুবাই, কাতার, সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, ওমান, কুয়েত ও পাকিস্তানসহ বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে এই শুঁটকি। এতে অর্জিত হচ্ছে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা।
ব্যবসায়ীদের তথ্যানুযায়ী, গত চার মাসে বাঁশখালী থেকে প্রায় ৯-১০ কোটি টাকার শুঁটকি বিক্রি হয়েছে। উপজেলার জালিয়াখালী নতুন বাজারের পশ্চিম পাশে এবং শেখেরখীল-ছনুয়া সীমান্তের ঢক এলাকা এখন শুঁটকি উৎপাদনের মূল কেন্দ্র।
ছনুয়া খুদুকখালি এলাকার শুঁটকি শ্রমিক তসলিমা বেগম বলেন, ‘মাছ বাছাই ও শুকানোর কাজ করে সংসার চালাই। দৈনিক হাজিরা হিসেবে যা পাই, তা দিয়ে কোনোমতে দিন পার করছি।’
সরল জালিয়াখালী নতুন বাজারের শুঁটকি ব্যবসায়ী মো. মহিউদ্দিন বলেন, ‘শীতের শুরু থেকেই আমরা পুরোদমে কাজ করছি। গত ৪ মাসে আমার প্রায় কোটি টাকার শুঁটকি বিক্রি হয়েছে। এখানে প্রতিদিন ৩০-৪০ জন শ্রমিক কাজ করেন। পুরুষ শ্রমিকরা দৈনিক ৭৫০-৮০০ টাকা এবং নারীরা ৬০০ টাকা মজুরি পান। ৬৫ দিনের মৎস্য আহরণ নিষেধাজ্ঞা শুরুর আগ পর্যন্ত এই উৎপাদন চলবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আধুনিক পদ্ধতিতে শুঁটকি উৎপাদন করা গেলে উৎপাদন আরও বাড়ানো সম্ভব হতো এবং শ্রমিকদের কষ্টও কমত। সরকারিভাবে ঋণ সহায়তা পেলে আমাদের উৎপাদন ক্ষমতা কয়েকগুণ বৃদ্ধি করা সম্ভব।’
পটিয়া থেকে আসা পাইকারি ব্যবসায়ী আব্দুল মালেক বলেন, ‘গত এক দশক ধরে আমি বাঁশখালী ও কুতুবদিয়া থেকে শুঁটকি কিনে চট্টগ্রামের চাক্তাইসহ বিভিন্ন মোকামে বিক্রি করি। প্রতি মৌসুমে খরচ বাদ দিয়ে ৩ থেকে ৪ লাখ টাকা লাভ থাকে।’
শেখেরখীল এলাকার ব্যবসায়ী হরি লাল দাশ বলেন, ‘আমাদের শুঁটকিতে কোনো ধরনের মেডিসিন ব্যবহার করা হয় না। তাই এর মান ও স্বাদ অত্যন্ত ভালো।’
এ বিষয়ে বাঁশখালী উপজেলা জ্যেষ্ঠ মৎস্য কর্মকর্তা মো. তৌসিব উদ্দিন বলেন, ‘বাঁশখালীর বিষমুক্ত ও সুস্বাদু শুঁটকি সারা দেশে জনপ্রিয়। এই পেশার আধুনিকায়নে সরকার মৎস্যজীবীদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও সহায়তা প্রদান করছে।’
তবে আধুনিক প্রযুক্তির অভাব ও সংরক্ষণের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকায় প্রতিবছর সাগর উপকূলে লাখ লাখ টাকার মাছ নষ্ট হয়। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এই খাত থেকে আরও বেশি রাজস্ব আয় সম্ভব বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।




Comments