যশোর-রাজগঞ্জ সড়কে কদবেল সাম্রাজ্য; দিনে অর্ধ লাখ টাকার লেনদেন
যশোর সদর উপজেলার বাগেরহাট বাজার। এই বাজারের উপর দিয়েই চলে গেছে ব্যস্ত যশোর থেকে রাজগঞ্জ সড়ক। নিত্যদিনের পরিবহন আর মানুষের কোলাহল ছাপিয়ে এই সড়কের বামদিকে রাস্তার পাশেই ছোট্ট একটি দোকানের সামনে ভিড় করছে উৎসুক জনতা। বাজারের পরিচিত গন্ডি ছাড়িয়ে এই স্থানটি এখন এক অভিনব দৃশ্যের জন্ম দিয়েছে। কারণ, এখানে এক ফল বিক্রেতা তাঁর পুরো দোকানটি সাজিয়ে রেখেছেন শুধু কদবেল দিয়ে।
এক, দুই বা কয়েক ডজন নয়, আক্ষরিক অর্থেই শত শত কদবেল দিয়ে এমনভাবে দোকানটিকে মুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে যে, ফলের প্রাচুুর্যে আড়াল হয়ে গেছেন স্বয়ং বিক্রেতাও। দূর থেকে দেখলে মনে হবে, যেন কোনো ফল প্রক্রিয়াজাতকরণ কোম্পানির প্রদর্শন কক্ষ! ২০ টাকা থেকে শুরু করে ৭০ টাকা মূল্যে প্রতি পিচ কদবেল বিক্রি করেন। তার দেখাদেখি আশে পাশে আরো কয়েকটি এই কদবেলের দোকান গড়ে উঠেছে।
এই সৃজনশীল উদ্যোগের কারিগর হলেন স্থানীয় উদ্যোক্তা মো: রফিকুল ইসলাম। রফিকুল ইসলামের এই ব্যতিক্রমী কদবেল-প্রদর্শনী এখন শুধু স্থানীয়দের কাছেই নয়, রাজগঞ্জ সড়ক দিয়ে চলাচলকারী যেকোনো মানুষের কাছেই এক নতুন আকর্ষণ। তার এই কৌশল এক সাধারণ মৌসুমী ফলের ব্যবসাকে এনে দিয়েছে অসাধারণ সফলতা।
লাখ টাকার ফল, ঝুলন্ত প্রদর্শনী:
রফিকুল ইসলামের দোকানে গেলেই চোখে পড়ে এক ব্যতিক্রমী দৃশ্য। টিন আর বাঁশের তৈরি সাধারণ এই দোকানটির কাঠামো সম্পূণ রুপে অদৃশ্য হয়ে গেছে চারপাশ থেকে ঝুলিয়ে রাখা কদবেলগুলোর ভিড়ে। প্রতিটি কদবেলকে পরিপাটি করে দড়িতে বেঁধে মালার মতো সারিবদ্ধভাবে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে দোকানের ছাদ এবং সামনের অংশজুড়ে। একেকটি কদবেলের মালা যেন ফলের এক নতুন নকশা তৈরি করেছে।
দোকানের কাছে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছিলেন মনিরামপুর উপজেলা থেকে আসা এক ক্রেতা মাসুদুর রহমান। মাসুদুর রহমান তাঁর মুগ্ধতা প্রকাশ করে এই প্রতিবেদককে জানান, ‘আমি মনিরামপুর থেকে আসছিলাম, রাস্তার পাশে এমন দৃশ্য দেখে প্রথমে থমকে যাই। কদবেল তো সারা জীবন দেখলাম, কিন্তু এভাবে কখনো দেখিনি। মনে হচ্ছে যেন কদবেলের কোনো মেলায় এসেছি! দোকানের সামনে এসে দেখি, দোকানদার রফিকুল ভাইকে কদবেলের ভিড়ে খুঁজেই পাওয়া যাচ্ছে না। এই যে নতুনত্ব, এটা সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে।
মাসুদুর রহমান বলেন, ‘অন্যান্য ফল বিক্রেতারা যেখানে শুধু স্তুপ করে ফল বিক্রি করেন, সেখানে রফিকুল ভাই এক ধরনের শিল্পকর্ম তৈরি করেছেন। এতে ফলের প্রতি ক্রেতার আকর্ষণ যেমন বাড়ে, তেমনি দাম দিতেও কোনো দ্বিধা থাকে না।
ব্যবসায়িক কৌশল ও সাফল্যের ইতিকথা:
রফিকুল ইসলামের এই কদবেল বিপ্লব শুধু চোখের শান্তি দেয় না, তাঁর ব্যবসায়িক সাফল্যেও এনেছে নতুন মাত্রা। তিনি জানান, এমন সৃজনশীলভাবে দোকান সাজানোর পর থেকে তাঁর দৈনিক বিক্রি কয়েকগুণ বেড়েছে।
মো: রফিকুল ইসলাম বলেন, ফল তো সবাই বিক্রি করে। আমি চিন্তা করলাম, এমন কী করা যায়, যাতে ক্রেতা দাঁড়িয়ে দেখতে বাধ্য হয়। এই সাজসজ্জা করার পর থেকে কাস্টমার ভালোই আসে। বিশেষ করে পথচারীরা দাঁড়িয়ে দেখতে দেখতেই ফল কিনে নিয়ে যান।
রফিকুল ইসলামের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, তিনি প্রতিদিন গড়ে দুই থেকে তিন হাজার টাকা মূল্যের কদবেল বিক্রি করেন। কদবেলের আকার ও মান অনুযায়ী প্রতিটি ফলের সর্বনিম্ন মূল্য ২০ টাকা এবং সর্বোচ্চ মূল্য ৭০ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। বাগেরহাট বাজারের মতো একটি অপেক্ষাকৃত ছোট স্থানে শুধু একটি ফলের এত বড় পরিসরে এবং এমন দামে বিক্রি হওয়াটা স্থানীয় ফল ব্যবসায় নতুন অর্থনৈতিক দিক নির্দেশ করে।
তিনি আরও জানান, এই বিপুল পরিমাণ কদবেল তিনি এক জায়গা থেকে সংগ্রহ করেন না। যশোরের বিভিন্ন উপজেলা এবং পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে তিনি তাজা ও মানসম্মত কদবেল সংগ্রহ করে আনেন। এতে স্থানীয় ফল সংগ্রাহক ও কৃষকরাও ন্যায্য দাম পাচ্ছেন এবং জীবিকা নির্বাহ করতে পারছেন।
মৌসুমী ফলের অর্থনৈতিক গুরুত্ব: এক কদবেল, বহু কর্মসংস্থান:
রফিকুল ইসলামের এই ব্যতিক্রমী উদ্যোগ সকলকে মনে করিয়ে দেয়, দেশীয় মৌসুমী ফলগুলো কেবল পুষ্টির উৎস নয়, গ্রামীণ অর্থনীতিতে এগুলোর বিশাল অবদান রয়েছে। কদবেল যখন পূর্ণাঙ্গভাবে বাজারে আসে, তখন তা কেবল রফিকুল ইসলামের মতো বিক্রেতাদের হাতেই পৌঁছায় না, এর পেছনে কাজ করে একটি বিশাল কর্মচক্র : কৃষকরা কদবেল চাষ বা গাছ রক্ষা করে একটি অতিরিক্ত আয়ের পথ খুঁজে পান। আজকাল বারোমাসি থাই কদবেলের মতো জাতগুলোর বাণিজ্যিক চাষাবাদের কারণে এই ফলের গুরুত্ব আরও বেড়েছে। গাছ থেকে ফল সংগ্রহ করা, বাজারজাত করার জন্য স্থানীয়ভাবে মজুরিভিত্তিক শ্রমিক নিয়োগ করা হয়। এরপর সেগুলো দেশের বিভিন্ন বাজারে পরিবহনের জন্য আরও কিছু মানুষের কর্মসংস্থান হয়।
রফিকুল ইসলামের মতো অসংখ্য ক্ষুদ্র বিক্রেতা এই ফল বিক্রির মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করেন। রফিকুল ইসলাম প্রমাণ করেছেন, সৃজনশীল বাজারজাতকরণ কৌশল এই কর্মচক্রকে আরও গতিশীল করে তুুলতে পারে। তাঁর দোকানে কদবেল কেনার জন্য ভিড় করা ক্রেতারা যেমন ফলের দাম দিচ্ছেন, তেমনি তাঁর এই কৌশলটি অন্যদেরও অনুপ্রাণিত করছে।
গ্রামীণ অর্থনীতিতে নতুন বার্তা:
রাজগঞ্জ সড়কের এই কদবেল-প্রদর্শনীর ঘটনাটি কেবল যশোরের নয়, পুরো দেশের গ্রামীণ অর্থনীতিতে এক নতুন বার্তা দিচ্ছে। সৃজনশীলতাই সাফল্যের চাবিকাঠি। ফল-সবজি বা যেকোনো কৃষিপণ্যের উৎপাদন যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি এর বাজারজাতকরণের ক্ষেত্রে নতুনত্বের ছোঁয়া দেওয়া আরও জরুরি। রফিকুল ইসলাম দেখিয়েছেন, তাঁর পরিশ্রম এবং বুদ্ধিমত্তা দিয়ে তিনি তাঁর ব্যবসার ক্ষেত্রে শুধু আর্থিক উন্নতিই করেননি, বরং স্থানীয় পণ্যকে একটি ব্র্যান্ডের রূপ দিয়েছেন। ফলস্বরূপ, বাগেরহাট বাজারের এই দোকানটি এখন কদবেল বিক্রির জন্য একটি ‘আইকনিক স্থান’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। ২০ টাকা থেকে শুরু করে ৭০ টাকা মূল্যে প্রতি পিচ কদবেল বিক্রি করেন।
গ্রামীণ পর্যায়ের এই ধরনের উদ্ভাবনী উদ্যোগগুলো যাতে যথাযথ মর্যাদা পায়। মো: রফিকুল ইসলামের মতো উদ্যোক্তারা দেশের অর্থনীতিতে নীরবে অবদান রাখছেন। তাদের এই প্রচেষ্টা যদি দেশের মূলধারার গণমাধ্যমে উঠে আসে, তবে আরও হাজার হাজার যুবক বা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী অনুপ্রাণিত হবেন।
রফিকুল ইসলাম দৃঢ় কণ্ঠে বলেন, ‘আমি চাই, মানুষ আমার এই কদবেলের দোকানের মাধ্যমে বোঝুক যে, ছোটখাটো জিনিসকেও সুন্দরভাবে সাজিয়ে তুলে বড় ব্যবসা করা সম্ভব। আমি সবসময় চেষ্টা করি ভালো মানের ফল দিতে, আর তাই কাস্টমারও ফিরে আসে বারবার।
যশোরের এই রাজগঞ্জ সড়কে প্রতিদিন হাজারো যানবাহন চলে। কিন্তু কদবেলের এই ঝলমলে দোকানটি যেন এক মুহূর্তের জন্য হলেও সব পথচারীকে থমকে যেতে বাধ্য করে। এটি শুধু একটি সফল ব্যবসার গল্প নয়, এটি গ্রামীণ উদ্ভাবন এবং দেশীয় ফলের অপার সম্ভাবনার এক জীবন্ত দলিল।




Comments