Image description

প্রকৃতিতে শীতের আগমনী বার্তা। সকালের শিশির আর হালকা কুয়াশার মধ্যে চুয়াডাঙ্গার জীবননগর উপজেলার গাছিরা এখন খেজুরের রস সংগ্রহের জন্য গাছ প্রস্তুতে মহাব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। ইতোমধ্যে হাতে দা ও কোমরে দড়ি বেঁধে নিপুণ হাতে গাছ চাঁছাছোলা ও নলি বসানোর কাজ শুরু করেছেন তাঁরা।

এ বছর জীবননগর উপজেলা থেকে ৭ কোটি টাকারও বেশি গুড় উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, যা স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে সারাদেশে সরবরাহ করা হবে।

জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কোমরে রশি বেঁধে গাছে ঝুলে এই রস সংগ্রহের কাজ করেন গাছিরা। প্রতিদিন বিকেলে গাছের সঙ্গে ছোট-বড় মাটির হাঁড়ি বাঁধা হয় এবং সকালে তা থেকে রস সংগ্রহ করা হয়। সংগৃহীত কাঁচা রস কেউ কেউ এলাকার বিভিন্ন স্থানে ও হাটে-বাজারে খাওয়ার জন্য বিক্রি করেন, আবার কেউ কেউ সকালেই তা দিয়ে সুস্বাদু গুড় তৈরির প্রক্রিয়া শুরু করেন।

শীত মৌসুম এলেই দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সর্বত্র খেজুরের রস আহরণ ও গুড় তৈরিতে এক নতুন উৎসবের আমেজ শুরু হয়। শীতের দিন মানেই খেজুর রস ও নলেন গুড়ের মৌ মৌ গন্ধ। শীতের সকালে খেজুরের তাজা রস যে কতটা তৃপ্তিকর, তা বলে বোঝানো যায় না। খেজুর রসের পিঠা, পায়েস, পাটালি ও প্রাকৃতিক ভিনেগার—সব মিলিয়ে নলেন গুড় ছাড়া বাঙালির শীতকালীন উৎসব যেন কল্পনাই করা যায় না। এখনও শীতকালে শহর থেকে মানুষ দলে দলে ছুটে আসে গ্রামে খেজুর রস খেতে।

গাছিদের প্রস্তুতি প্রসঙ্গে উথলী গ্রামের আনোয়ার মল্লিকের ছেলে কাদের মল্লিক জানান, ১০ দিন আগে কাজ শুরু করেছেন। গাছের ময়লা ও ডালপালা ছেঁটে ফেলা হয়েছে এবং ধারালো দা দিয়ে গাছের সোনালী অংশ বের করে নলি স্থাপনের কাজও প্রায় শেষ। তবে তিনি হতাশা প্রকাশ করে বলেন, এক কেজি গুড় তৈরি করতে ১০০ থেকে ১১০ টাকা খরচ হয়, অথচ বিক্রি করতে হয় মাত্র ১২০-১৩০ টাকা দরে। এ কারণে অনেক চাষি গুড় বানাতে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন।

দেহাটি গ্রামের গাছি লিয়াকত হোসেন জানান, আর সপ্তাহ দুয়েক পরই পুরোদমে রস সংগ্রহের পর্ব শুরু হবে। তিনি ৪০টি গাছ বর্গা নিয়েছেন এবং ৪০টি তাঁর নিজের। তিনি জানান, গাছ একবার ছাঁটলে তিন-চার দিন রস সংগ্রহ করা যায়।

কাটাপোল গ্রামের গাছি আবু তালেব এই ঐতিহ্য রক্ষায় গুরুত্বারোপ করে বলেন, বর্তমানে যে হারে খেজুর গাছ হারিয়ে যাচ্ছে, তাতে এই ঐতিহ্য ধরে রাখতে তালগাছের মতো বেশি বেশি খেজুর গাছ লাগানো এবং তার যত্ন নেওয়া সবার উচিত।

যাদবপুর গ্রামের ইসমাইল হোসেন বলেন, জীবননগর উপজেলার খেজুর গাছের রস হতে উৎপাদিত গুড়ের দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। তবে তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করে জানান, অবৈধভাবে গড়ে ওঠা ইটভাটার কারণে গ্রামীণ অর্থনীতির এই ঐতিহ্য আজ বিলুপ্তির পথে। প্রতিদিন ইটভাটায় জ্বালানির কাজে এলাকার শত শত খেজুর গাছ নিধন করা হচ্ছে। এর পরও গাছিরা তাদের ঐতিহ্য ধরে রাখতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

স্থানীয়রা বলছেন, আর মাত্র কয়েকদিন পরই গাছ থেকে রস সংগ্রহ শুরু হবে, যা চলবে প্রায় ফাল্গুন মাস পর্যন্ত। হেমন্তের প্রথমে বাজারগুলোতে উঠতে শুরু করবে সুস্বাদু খেজুরের পাটালি ও গুড়।

চুয়াডাঙ্গা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. মাসুদুর রহমান সরকার জানান, জেলায় এ বছর রস সংগ্রহের জন্য ২ লাখ ৭২ হাজার খেজুর গাছ প্রস্তুত করা হচ্ছে। শীত মৌসুমে প্রতিটি গাছ থেকে গড়ে ১০ কেজি গুড় পাওয়া যায়। সে হিসাবে এসব গাছ থেকে গুড় উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২ হাজার ৭০০ মেট্রিক টন। তিনি আরও বলেন, সারা দেশেই এ জেলার গুড়ের চাহিদা সব সময় বেশি থাকে। শীতকালীন এই মৌসুমি পেশায় জেলার প্রায় ৩০ হাজার চাষি সম্পৃক্ত রয়েছে।