
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) শিক্ষার্থী ও ছাত্রদল নেতা জোবায়েদ হোসাইন হত্যার ঘটনার প্রধান সন্দেহভাজন মাহির রহমান। গত রোববার সন্ধ্যার দিকে তিনি রক্তাক্ত ও ক্ষত হাত নিয়ে বাসায় মাকে পুরো ঘটনার বর্ণনা দেন। এরপর মাহিরের চিকিৎসার জন্য কেরানীগঞ্জের হাসনাবাদ এলাকায় নিয়ে যান মা রেখা রহমান। ছেলেকে গতকাল সোমবার সকালে পুলিশে সোপর্দ করেছেন তিনি।
রেখা রহমান বলেন, ‘আমার ছেলের সঙ্গে ওই মেয়ের (জোবায়েদের ছাত্রীর) ৯ বছরের সম্পর্ক ছিল। তারা একই সঙ্গে বড় হয়েছে। কিন্তু কিছুদিন আগে ওই মেয়ে আমার ছেলেকে জানায়, সে আর সম্পর্ক রাখবে না। রোববার সন্ধ্যায় জোবায়েদ টিউশনিতে যাওয়ার পথে মাহিরের সঙ্গে দেখা হয়। সে মাহিরকে ডেকে তার মোবাইল ফোন থেকে বর্ষার ছবি মুছে ফেলতে বলে। মাহিরের বন্ধু ইলান নামের আরেক ছেলে ঘটনাস্থলে ছিল। একপর্যায়ে মাহির এবং ওই ছেলের মধ্যে ঝগড়া বাধে এবং তাতে জোবায়েদ দুর্ঘটনাবশত নিহত হয়। পরে আমার ছেলে রক্তাক্ত ও ক্ষত হাত নিয়ে বাসায় আমাকে পুরো ঘটনার বর্ণনা দেয়। সে অপরাধ করেছে, তাই তাকে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছি।’
রোববার রাতে পুরান ঢাকার আরমানিটোলা এলাকার একটি ভবনের সিঁড়ি থেকে জোবায়েদের রক্তাক্ত মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। তাঁর গলায় ছুরিকাঘাতের চিহ্ন ছিল। জোবায়েদ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষার্থী। তিনি ছাত্রদলের জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখার আহ্বায়ক কমিটির সদস্য ছিলেন। সহপাঠী ও পুলিশের তথ্যমতে, আরমানিটোলার এই ভবনের একটি বাসায় উচ্চ মাধ্যমিকের এক ছাত্রীকে পড়াতেন জোবায়েদ। তাঁর মরদেহ উদ্ধারের পর ওই ছাত্রীকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য বংশাল থানায় নিয়ে যায় পুলিশ। এ হত্যাকাণ্ডে ওই ছাত্রীসহ চারজনকে আটক করেছে পুলিশ। বাকি তিনজনের মধ্যে একজন মাহির। অন্য দু’জনও যুবক, তবে তাদের নাম-পরিচয় জানা যায়নি।
লালবাগ অঞ্চলের ডিসি মল্লিক আহসান উদ্দিন সামি বলেন, তদন্তের স্বার্থে সবার পরিচয় আমরা প্রকাশ করছি না। মঙ্গলবার (আজ) সকালে বিস্তারিত জানানো হবে।
বংশাল থানার ওসি রফিকুল ইসলাম বলেন, মাহির রহমান শেখ বোরহানুদ্দীন পোস্ট গ্র্যাজুয়েট কলেজের সম্মান প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী। তাঁর প্রেমিকা পড়েন ঢাকা মহানগর মহিলা কলেজের উচ্চ মাধ্যমিক দ্বিতীয় বর্ষে। পাশাপাশি বাড়িতে তাদের বেড়ে ওঠা ছোট থেকে। তারা চতুর্থ শ্রেণি থেকে একে অপরকে পছন্দ করেন। কিন্তু সম্প্রতি তাদের সম্পর্কে টানাপোড়েন ঘটে। মাহিরকে তাঁর প্রেমিকা জানিয়ে দেন, তিনি জোবায়েদকে পছন্দ করেন। এটা জানার পর ক্ষোভে মাহির তার বন্ধুকে নিয়ে জোবায়েদকে হত্যা করেছে।
জোবায়েদ হত্যার ঘটনায় গতকাল রাত ১০টা পর্যন্ত মামলা হয়নি। স্বজনরা জানিয়েছেন, ওই ছাত্রী, তার বাবা-মা, মাহির রহমান ও তার বন্ধু মো. নাফিসের নাম উল্লেখ করে গতকাল ভোরে বংশাল থানায় মামলা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পুলিশ মামলা নেয়নি।
জোবায়েদের বড় ভাই এনায়েত হোসেন সৈকত বলেন, ‘পাঁচজনের নামে মামলা দিতে চেয়েছি। বংশাল থানার ওসি এত জনের নামে মামলা না দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ওই মেয়ের মা-বাবার নামে মামলা দিলে নাকি মামলা হালকা হয়ে যাবে। কিন্তু আমরা মামলায় তাদের নাম উল্লেখ করতে চাই। আমার ভাই হত্যার বিচার চাই।’
এ বিষয়ে বংশাল থানার ওসি রফিকুল বলেন, ‘নিহতের পরিবার যে কয়জনের নামে মামলা দিতে চায় নেব। তবে তাদের বলেছি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সঙ্গে আলোচনা করে তারপর সিদ্ধান্ত নিতে।’
স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মিটফোর্ড হাসপাতালে ময়নাতদন্তের পর দুপুর ১টার দিকে জোবায়েদের মরদেহ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করে পুলিশ। জবি ক্যাম্পাসে জানাজা শেষে মরদেহ তাঁর গ্রামের বাড়িতে নেওয়া হয়। বাদ মাগরিব কুমিল্লার হোমনা উপজেলার আসাদপুর ইউনিয়নের কলাগাছিয়া স্কুল মাঠে দ্বিতীয় দফা জানাজার পর কলাগাছিয়া গ্রামের কবরস্থানে তাঁর দাফন সম্পন্ন হয়েছে।
জোবায়েদের মৃত্যুতে কান্না থামছে না বাবা মোবারক হোসেনের। গতকাল ভোর ৫টায় বংশাল থানায় মামলার প্রস্তুতিকালে তিনি বলেন, ‘কোলেপিঠে কইরা ২৫টা বছর পাইলা বড় করছি আমার জুবুরে। কত স্বপ্ন ছিল তাকে নিয়ে। কত স্বপ্ন নিয়ে ঢাকায় পাঠাইছিলাম। আজ আমার জুবুর মরদেহ নিতে ঢাকা আইছি। আমার জুবু আমারে আর বাপ কইয়া ডাকবো না। আমার জুবু আর আইবো না।’
জোবায়েদ হোসেনের হত্যার ঘটনায় আগামীকাল বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় দিবসের সব কার্যক্রম স্থগিত করা হয়েছে। একই সঙ্গে তাঁর স্মরণে আজ ও কাল শোক পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রশাসন। গতকাল বিশ্ববিদ্যালয় এক ভার্চুয়াল সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। শোকের দুই দিনের প্রথম দিন শোক সভা এবং দ্বিতীয় দিন বিশ্ববিদ্যালয়ে র্যালি করা হবে।
উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. রেজাউল করিম বলেন, ‘জোবায়েদের মৃত্যু আমাদের গভীরভাবে শোকাহত করেছে। তাই এবারের বিশ্ববিদ্যালয় দিবস উদযাপন স্থগিত করা হলো। জোবায়েদ হত্যার সুষ্ঠু বিচার না হওয়া পর্যন্ত আমরা থামব না।’
গতকাল জবি ক্যাম্পাসে সংবাদ সম্মেলনে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দিন নাসির বলেন, জোবায়েদের বড় ভাই সৈকত ৪৯তম বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। কিন্তু জোবায়েদ সে খুশির খবর জেনে যেতে পারল না। তার হত্যাকারীর দ্রুত সময়ের মধ্যে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
এদিকে জোবায়েদ হত্যার প্রতিবাদে ও দ্রুত বিচার নিশ্চিতের দাবিতে গতকাল বিক্ষোভ মিছিল করেছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদল।
Comments