নওগাঁর মাজরা পোকা ও ছত্রাকের দ্বিমুখী আক্রমণে আমন ফলন বিপর্যয়, দিশেহারা কৃষক
উত্তরাঞ্চলের খাদ্যভান্ডার হিসেবে পরিচিত নওগাঁ জেলায় রোপা আমন ধানের মৌসুমে চরম বিপর্যয় নেমে এসেছে। মাজরা পোকা, পাতা মোড়ানো পোকা, ব্লাস্ট ও খোলপচা জাতীয় ক্ষতিকর ছত্রাকের দ্বিমুখী আক্রমণে জেলার বিস্তৃত ধানক্ষেত এখন ফসলশূন্য হওয়ার পথে। ধান কেটে ঘরে তোলার মাত্র কয়েক দিন আগে ফসলের এমন পরিণতিতে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন হাজার হাজার কৃষক। বিঘা প্রতি সাত-আট হাজার টাকা খরচ করেও ফলন না পাওয়ায় ঋণের বোঝায় বিপর্যস্ত তাঁরা।
জেলার ১১টি উপজেলার মধ্যে সদর, মহাদেবপুর, মান্দা, আত্রাই, নিয়ামতপুর, পোরশা, পত্নীতলা এবং রাণীনগরের বিভিন্ন মাঠে রোগ ও পোকার আক্রমণ ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। দূর থেকে দেখলে মনে হয় মাঠের ধান পেকে সোনালি হয়ে গেছে। কিন্তু কাছে গেলে দেখা যায়, ধানগাছগুলো হলুদ হয়ে শুকিয়ে খড়ে পরিণত হয়েছে এবং শীষগুলো চিটা পড়ে সাদা হয়ে গেছে। ধানের গোড়ায় পচন ও পাতায় ছত্রাকের ব্যাপক দাগ দৃশ্যমান।
আক্রান্ত ক্ষেতগুলোতে মাজরা পোকার আক্রমণ সবচেয়ে বেশি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এই পোকার কীড়া ধানের কাণ্ডের ভেতর প্রবেশ করে ভেতরের অংশ খেয়ে ফেলে। এতে ধানের থোড় আসার আগেই গাছ মরে যায়, যাকে বলা হয় 'মরা ডিগ'। আর শীষ বের হওয়ার পর আক্রমণ করলে শীষ শুকিয়ে সাদা হয়ে যায় এবং ভেতরে কোনো চাল তৈরি হয় না—কৃষকদের ভাষায় এটি 'সাদা শীষ' বা 'চিটা শীষ'।
মাজরা পোকার পাশাপাশি 'ব্লাস্ট' ও 'খোল পচা' নামক ছত্রাকজনিত রোগ মারাত্মক ক্ষতি করেছে। ব্লাস্ট রোগের কারণে ধানের শীষের গোড়া কেটে যাচ্ছে, ফলে শীষ বের হলেও তা চিটা হয়ে যাচ্ছে। এছাড়া খোল পচা রোগের কারণে গাছের গোড়ায় পচন ধরছে, যার ফলে পুরো গাছ শুকিয়ে মরে যাচ্ছে।
নওগাঁ সদর উপজেলার বাচারী গ্রামের কৃষক হামিদুল হক হতাশা নিয়ে বলেন, "পাঁচবার ওষুধ দিয়েও পোকা ও ছত্রাককে বাগে আনা যায়নি। বিঘা প্রতি সাত-আট হাজার টাকা খরচ করে এখন মাঠের ধান খড় হয়ে যাচ্ছে। মহাজনের ঋণ কী দিয়ে শোধ করব, জানি না।"
মহাদেবপুর উপজেলার উত্তর গ্রামের আরেক কৃষক মাহবুব আলম আক্ষেপ করে বলেন, "ধান কাটার সময় হয়ে এলো, অথচ ক্ষেতের ধান চিটা হয়ে যাচ্ছে। এবার উৎপাদন খরচও উঠবে না। গত কয়েক বছরের মধ্যে এমন ভয়াবহ আক্রমণ আগে দেখিনি।"
কৃষকদের অভিযোগ, কৃষি বিভাগের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সময়মতো পাশে পাওয়া যায়নি। ফলে কীটনাশক বিক্রেতাদের মনগড়া পরামর্শে ওষুধ প্রয়োগ করেও ফল মেলেনি।
নওগাঁ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, চলতি আমন মৌসুমে জেলায় প্রায় ১ লক্ষ ৯৪ হাজার হেক্টর জমিতে রোপা আমন ধানের আবাদ করা হয়েছিল। তবে দেরিতে বৃষ্টি শুরু হওয়া এবং এরপর তীব্র গরম ও অস্বাভাবিক আবহাওয়ার কারণে রোগবালাই বেড়েছে।
নওগাঁ কৃষি বিভাগের উপ-পরিচালক মোছাঃ হোমায়রা মন্ডল এ বিষয়ে বলেন, "এবারের অস্বাভাবিক আবহাওয়ার কারণে পোকা ও ছত্রাকের আক্রমণ বেড়েছে। বিশেষ করে মাজরা পোকা ও ব্লাস্ট রোগের প্রকোপ দেখা দিয়েছে। আমরা মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সতর্ক করে কৃষকদের সঠিক সময়ে, সঠিক মাত্রায় অনুমোদিত বালাইনাশক স্প্রে করার পরামর্শ দিচ্ছি। তবে কৃষকদের যত্রতত্র কীটনাশক ব্যবহার না করে কৃষি অফিসের পরামর্শ নেওয়ার জন্য বারবার আহ্বান জানানো হচ্ছে।"
তিনি আরও বলেন, "প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী, জেলায় প্রায় ৫ হাজার হেক্টর জমির ধান বিভিন্ন রোগবালাইয়ে আক্রান্ত হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যদিও সঠিক ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণে কাজ চলছে। আমরা ফলন বিপর্যয়ের মাত্রা কমাতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।"
কৃষি বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, মৌসুমের শেষ দিকে এসে ধানের শীষ আসার সময় আবহাওয়ার পরিবর্তন, জমিতে নাইট্রোজেন সারের অতিরিক্ত ব্যবহার এবং উপযুক্ত বালাইনাশক প্রয়োগ না করার কারণেই এই ধরনের বিপর্যয় ঘটছে।
তাঁরা পরামর্শ দিয়ে বলছেন, মাজরা পোকার ডিমের গাদা সংগ্রহ করে নষ্ট করা, আলোর ফাঁদ ব্যবহার করা এবং আক্রান্ত জমিতে অনুমোদিত দানাদার বা তরল কীটনাশক সঠিক মাত্রায় ব্যবহার করা জরুরি। ছত্রাক দমনে কার্বনডাজিম বা টেবুকোনাজল গ্রুপের ছত্রাকনাশক স্প্রে করার পরামর্শও দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে সবকিছুই কৃষি বিভাগের তত্ত্বাবধানে করা উচিত।
কৃষি অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, ফলন বিপর্যয়ের মুখে পড়া কৃষকদের জন্য সরকার বিশেষ প্রণোদনা ঘোষণা করে পাশে না দাঁড়ালে খাদ্য উদ্বৃত্তের এই অঞ্চলে কৃষিখাতে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। তাঁরা দ্রুত ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের তালিকা তৈরি করে প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদানের দাবি জানিয়েছেন।
Comments