Image description

চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ১৪৮ কিলোমিটার দীর্ঘ মহাসড়কটি এখন দক্ষিণ চট্টগ্রামের মানুষের কাছে 'মরণফাঁদ' হিসেবে পরিচিত। সাতকানিয়া, লোহাগাড়া, চকরিয়াসহ বিভিন্ন স্থানে প্রতিনিয়ত সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে। মূলত দুই লেনের এই মহাসড়কটি বর্ধিত যানবাহনের চাপ সামলাতে না পারায় দুর্ঘটনা বেড়েই চলেছে। ফলে মহাসড়কটি ছয় লেনে উন্নীত করার দাবি দীর্ঘদিনের হলেও বাস্তবায়ন না হওয়ায় আন্দোলনের তীব্রতা বাড়ছে।

প্রতি বছর লাখ লাখ পর্যটক কক্সবাজারে ভ্রমণ করেন। এর পাশাপাশি পণ্যবাহী ভারী, মাঝারি এবং দূরপাল্লার অসংখ্য যানবাহন এই মহাসড়ক দিয়ে চলাচল করে। ফলস্বরূপ, যানজট এবং দুর্ঘটনা এখন এই মহাসড়কের নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা, যা এটিকে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে।

বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, গত তিন মাসে এই মহাসড়কে ৫৪টি দুর্ঘটনায় ৪০ জন নিহত এবং ৭৩ জন আহত হয়েছেন। বিশেষ করে ঈদ-উল-ফিতরের পরবর্তী ৭২ ঘণ্টায় লোহাগাড়া উপজেলার ঝাংগালিয়া মাজার গেট এলাকায় দুটি পৃথক দুর্ঘটনায় ১৭ জন নিহত ও ৩০ জন আহত হন। মুখোমুখি সংঘর্ষ, খাদে পড়ে যাওয়া, বৃষ্টি বা লবণের পানির কারণে পিচ্ছিল রাস্তা এবং নিয়ন্ত্রণ হারানোর মতো কারণে প্রায়শই দুর্ঘটনা ঘটছে। প্রতিটি দুর্ঘটনায় অসংখ্য প্রাণহানি ঘটলেও দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ না থাকায় যানজট ও দুর্ঘটনা মহাসড়কে একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

কক্সবাজার-চট্টগ্রাম মহাসড়কের শতাধিক বিপজ্জনক বাঁক রয়েছে। শুধু সাতকানিয়ার কেরানীহাট থেকে চুনতি পর্যন্ত ৩২ কিলোমিটার অংশেই ১০টিরও বেশি এমন বাঁক বিদ্যমান। এ ছাড়া দুই পাশে ঘন জঙ্গল থাকায় দূর থেকে এসব বাঁক সহজে বোঝা যায় না, যা দুর্ঘটনার ঝুঁকি আরও বাড়ায়। বাংলাদেশ প্রতিদিনের প্রকাশিত প্রতিবেদন সূত্রে চট্টগ্রাম সড়ক বিভাগ জানিয়েছে, চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০০ কিলোমিটারই ঝুঁকিপূর্ণ, যার মধ্যে ৮৩ কিলোমিটারে ৩০টিরও বেশি বিপজ্জনক বাঁক রয়েছে।

যানজট ও দুর্ঘটনার কারণে স্থানীয় জনগণ বিভিন্ন সময়ে প্রতিবাদ ও আন্দোলন করেছেন। গত ১৭ অক্টোবর ২০২৫ তারিখে লোহাগাড়া উপজেলায় স্থানীয়রা মহাসড়ক অবরোধ করে ছয় লেনে উন্নীত করার দাবি জানান। একই সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও ছয় লেনে উন্নীত করার দাবিতে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা ও আন্দোলন গড়ে উঠেছে। আন্দোলনকারীরা অভিযোগ করেন, "পুনরাবৃত্ত দুর্ঘটনার পরেও সরকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি।" চট্টগ্রাম-১৫ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও মহানগর জামায়াতে ইসলামের সাবেক আমির শাহজাহান চৌধুরী হুঁশিয়ারি দিয়েছেন যে, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক দ্রুত ছয় লেনে উন্নীত না করা হলে দক্ষিণ চট্টগ্রামের মানুষ কঠোর আন্দোলনে নামবে।

চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কটি বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পরিবহন সড়ক। এই মহাসড়ক দিয়ে কক্সবাজারের পর্যটন শিল্পের সঙ্গে যুক্ত ব্যবসা-বাণিজ্য ও অন্যান্য কার্যক্রম পরিচালিত হয়। এছাড়াও সামরিক পরিবহন, জরুরি পরিবহন এবং রোহিঙ্গাদের জন্য ত্রাণ সহায়তা পৌঁছাতে এই মহাসড়কটি ব্যবহৃত হয়। তাই এই মহাসড়কের উন্নয়ন দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

তবে মহাসড়কটি ছয় লেনে উন্নীত করার প্রয়োজনীয়তা থাকলেও এর পরিবেশগত প্রভাবও বিবেচনা করা জরুরি। চুনতি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য দিয়ে এই মহাসড়কটি চলে, যেখানে হাতি ও অন্যান্য বন্যপ্রাণীর চলাচল রয়েছে। মহাসড়ক সম্প্রসারণের ফলে বন্যপ্রাণীদের চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হতে পারে। তবে, সঠিক পরিকল্পনা ও পরিবেশগত সমন্বয়ের মাধ্যমে এই সমস্যা সমাধান সম্ভব।

বিভিন্ন সূত্র অনুযায়ী জানা যায়, সরকার ইতোমধ্যে মহাসড়কটি ছয় লেনে উন্নীত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। তবে ভূমি অধিগ্রহণের জটিলতা ও অন্যান্য প্রশাসনিক কারণে প্রকল্পের বাস্তবায়ন বিলম্বিত হচ্ছে। যদিও প্রকল্পের ৮২% কাজ সম্পন্ন হয়েছে, তবুও ভূমি অধিগ্রহণের জটিলতা প্রকল্পের অগ্রগতিতে বাধা সৃষ্টি করছে। এছাড়াও জাতীয় একটি ইংরেজি পত্রিকার সূত্রে জানা যায়, DPP (Development Project Proposal) অনুযায়ী, ১৩৬ কিমি ছয়-লেন রাস্তাটির জন্য অনুমোদন প্রক্রিয়াধীন।

সচেতন মহল মনে করছে, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কটি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যানজট, দুর্ঘটনা ও পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হলে এই মহাসড়কটি ছয় লেনে উন্নীত করা প্রয়োজন। সরকারের উচিত দ্রুত ভূমি অধিগ্রহণের জটিলতা সমাধান করে প্রকল্পটির বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা। এতে জনগণের জীবনমান উন্নয়ন, পরিবহন খাতের উন্নতি এবং দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সম্ভব হবে।

কয়েকজন শিক্ষার্থী জানান, সড়কটি দিয়ে দেশের বিভিন্ন স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যাতায়াত করছে। ছয় লেন উন্নীত না হওয়ায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তারা যাতায়াত করছেন।

আন্দোলনকারীরা হুঁশিয়ারি দিয়েছেন যে, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক ছয় লেনে উন্নীত করা গণমানুষের দাবি এবং উন্নয়নের বাস্তব দৃশ্য না দেখলে আন্দোলন কঠোর থেকে কঠোর হবে।