তিস্তা নদী। উত্তরের ২ কোটি মানুষের জীবনচিত্র গড়ে উঠেছে এ নদীকে ঘিরে। যে তিস্তা নদী এ অঞ্চলের মানুষের জীবন জীবিকার মাধ্যম হওয়ার কথা, যে তিস্তা নদী এ অঞ্চলের মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন করার কথা, সেই তিস্তা নদী এ অঞ্চলের মানুষের কাছে অভিশাপ হয়ে উঠেছে।
তিস্তা নদী যেন "মরার উপর খাঁড়ার ঘা"। সেই তিস্তা নদীকে ঘিরে বরাবর ভোটের রাজনীতি হয়েছে। ভোট আসলে প্রার্থীরা তিস্তা পাড়ে ছুটে যায়, তিস্তা খনন, তিস্তা নদীর বাঁধসহ নানা স্বপ্ন দেখায় লোকজনকে। কিন্তু ভোট চলে গেলে আর দেখা মেলে না এমপি-মন্ত্রীদের। তিস্তা নদী এ অঞ্চলের মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন করতে না পারলেও লক্ষ লক্ষ পরিবারকে করেছে বসতভিটা হারা। যাদের ছিল পুকুর ভরা মাছ, গোয়াল ভরা গরু, গোলা ভরা ধান তারা এখন দিনমজুর। কেউ রাস্তার ধারে, কেউ বা আবার ঢাকায় শ্রমিকের কাজ করে বস্তিতে গড়ে তুলেছে জীবন সংসার।
দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন সংগঠন তিস্তা নদী রক্ষায় নানা আন্দোলন করে আসছে। ২০১৭ সালে লালমনিরহাটের হাতীবান্ধায় “তিস্তা বাম তীর রক্ষা গণ-কমিটি”র ব্যানারে এ আন্দোলনের সূচনা হয়। পরে “তিস্তা বাঁচাও নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদ” নামে এক সংগঠনের মাধ্যমে রংপুরের ৫ জেলা লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধায় এ আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। তবে বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক আসাদুল হাবিব দুলুর নেতৃত্বে “তিস্তা নদী রক্ষা আন্দোলন”র ব্যানারে এ আন্দোলন নতুন মাত্রা পায়।
রাজপথে নেমে এসেছে উত্তরের ২ কোটি মানুষ। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের ১৭ ও ১৮ তারিখে ৫ জেলার ১১টি পয়েন্টে লক্ষ লক্ষ মানুষ দুই দিন তিস্তাপাড়ে অবস্থান করে “তিস্তা মহাপরিকল্পনা” বাস্তবায়নের দাবী তুলেন। ওই আন্দোলনে সরকারের টনক নড়ে। ওই সময় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান প্রতিশ্রুতিও দেন, আগামীতে বিএনপি ক্ষমতায় গেলে প্রথম কাজ হবে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা।
পরবর্তীতে বর্তমান সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের একটি প্রতিনিধি দল উত্তর অঞ্চলে এসে ঘোষণা দেয়, আগামী বছরের জানুয়ারির মাঝে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজ শুরু করবেন। কিন্তু সেটা মানতে নারাজ তিস্তাপাড়ের লোকজন। তাদের বক্তব্য, জানুয়ারি মাসে নির্বাচনে সবাই ব্যস্ত থাকবেন, তাই চলতি বছরের নভেম্বরে কাজ শুরু করতে হবে। চলতি বছরের নভেম্বরে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজ শুরুর দাবীতে নতুন করে আবারও শুরু হয় আন্দোলন। গত কয়েক মাস ধরে উত্তরাঞ্চলের মানুষ একের পর এক কর্মসূচি পালন করে আসছে বিভিন্ন সংগঠন। সর্বশেষ ১৬ অক্টোবর তিস্তার দুই তীরে ১০৫ কিলোমিটারজুড়ে মশাল প্রজ্বলন করা হয়।
নদী ও চর নিয়ে কাজ করে এমন একাধিক সংগঠনের সাথে কথা বলে জানা গেছে, যদি তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হয়, তাহলে উত্তরের ৫ জেলার লক্ষ লক্ষ হেক্টর বালু চর কৃষি জমিতে পরিবর্তিত হবে। এতে এ অঞ্চলে কৃষিতে একটা বিপ্লব ঘটবে যা জাতীয় অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখবে। পাশাপাশি ৫ জেলার লক্ষ লক্ষ পরিবার একদিকে তাদের বসতভিটা ফিরে পাবে, অন্যদিকে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে এ অঞ্চলে। তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন ছাড়া অন্য কোনো উন্নয়ন প্রকল্প শতভাগ সফল হবে না।
আন্দোলনের সঙ্গে যুক্তরা জানিয়েছেন, আন্দোলন চলবে। এটি একটি জন আন্দোলনের শক্তির প্রকাশ। শিক্ষার্থী থেকে ব্যবসায়ী, পরিবহন শ্রমিক থেকে কৃষক সবাই একই স্লোগানে একতাবদ্ধ হয়ে বলবেন: “জাগো বাহে, তিস্তা বাঁচাও। ন্যায্য হিস্যা চাই। মহাপরিকল্পনা চাই।” তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত এই আন্দোলন চলবে এমন অঙ্গীকারই শোনা যাচ্ছে তিস্তাপাড়ের প্রতিটি মানুষের কণ্ঠে।
তিস্তা বাঁচাও নদী বাঁচাও সংগ্রাম কমিটির সাধারণ সম্পাদক সফিয়ার রহমান জানান, তিস্তাপাড়ে বসবাসকারী মানুষের জীবন-জীবিকা এই নদীর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কৃষি, মাছ, নদীকেন্দ্রিক ব্যবসা—সব কিছুই নির্ভরশীল পানির প্রবাহে। দুই কোটি মানুষের ভাগ্য ঝুলছে তিস্তার পুনরুজ্জীবনের সঙ্গে। তিস্তা শুকিয়ে গেলে আমাদের জমি মরুভূমি হয়ে যায়। তিস্তা বাঁচানো মানে আমাদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ বাঁচানো।
তিস্তা নদী রক্ষা আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক আসাদুল হাবিব দুলু বলছেন, তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন না হলে উত্তরাঞ্চল মরুভূমিতে পরিণত হবে। আমরা চাই সরকার নির্বাচনের আগে এই কাজ শুরু করুক। না হলে তিস্তাপাড়ের মানুষকে নিয়ে বৃহত্তর আন্দোলনে নামতে বাধ্য হবো। তার ভাষায়, এটি কোটি মানুষের গর্জন— যার বার্তা স্পষ্ট: “তিস্তা বাঁচলে উত্তরবঙ্গ বাঁচবে, তিস্তা বাঁচলেই বাংলাদেশ বাঁচবে।”
 
                



 
               
Comments