Image description

শীত এলেই ব্যস্ততা বাড়ে বাউফলের ঐতিহ্যবাহী লেপ-তোষক কারখানাগুলোতে। উপজেলার বিভিন্ন গ্রামও এই শিল্পের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। বছরের পাঁচ মাস কার্তিক থেকে ফাগুন, এই অঞ্চলের লেপ ও তোষক কারিগরদের প্রধান কর্মমৌসুম। মৌসুমে তাদের কর্মব্যস্ততা থাকলেও অফ সিজনে বেকারত্ব ও অনিশ্চয়তার মুখে পড়তে হয় বেশিরভাগ কারিগরকে। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও টিকে থাকার সংগ্রাম যেন তাদের নিত্যসঙ্গী।

উপজেলার লেপ-তোষকের কাজের সুনাম যেমন আছে, তেমনি আছে কষ্ট, পরিশ্রম ও আর্থিক অস্থিরতা।  নাজিরপুর ছোট ডালিমা গ্রামের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের কারিগর মো. হেলাল (৪২) এই পেশায় আছেন দীর্ঘ ২৪ বছর। পিতা সত্তর গাজীর পেশাগত ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন তিনি।

হেলাল বলেন, “মৌসুমে কাজ থাকে, তখন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ব্যস্ত থাকতে হয়। কিন্তু অফ সিজনে প্রায়ই কাজ না থাকায় দুশ্চিন্তায় পড়তে হয় পরিবার নিয়ে।’’

হেলালের সঙ্গে কাজ করেন বাউফল পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের মোহাম্মদ মিলন (৩৫)। মিলন জানান, সিজনে দিনে গড়ে ৭–৮টি লেপ বা তোষক তৈরি করতে পারেন তারা। দুইজন মিলে একটি লেপ তৈরি করতে সময় লাগে প্রায় এক ঘণ্টা। তবে সিজন শেষ হলে কাজ কমে এসে দৈনিক দুই-তিন পিসে ঠেকে। ফলে উপার্জনও হয়ে যায় অর্ধেকের কম।

কারিগররা জানিয়েছেন, তুলা এবং পলি ফোম—এই দুটি কাঁচামালের দামের ওঠানামা তাদের শ্রমের মূল আয়কে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করে। প্রতিটি লেপ তৈরিতে লাগে ৬ থেকে ৭ কেজি তুলা। তুলার দাম কেজিপ্রতি কখনো ৫০ টাকা, কখনো ৬০ বা ৭০ টাকাও হয়ে থাকে। আর পলি ফোমের পাইকারি দাম কেজিপ্রতি ৭০ থেকে ৭৫ টাকা।

তোষক তৈরির ক্ষেত্রে খরচ আরও বেশি। একটি তোষকে তুলা লাগে ১৫ থেকে ২০ কেজি, যার দাম ১,৬০০ থেকে ২,২০০ টাকার মধ্যে ওঠানামা করে। 
মিলন বলেন, “দাম বাড়লে আমাদের লাভের পরিমাণ কমে যায়। আবার কম দামে বিক্রি করলে খরচই উঠে না। তাই প্রতিনিয়ত হিসাব কষে চলতে হয়।”

তাদের তৈরি ছোট লেপ বাজারে বিক্রি হয় ১,২০০ টাকা, আর বড় লেপ ১,৭০০ টাকা। প্রতিটি পিস তৈরির জন্য মালিকপক্ষ থেকে তারা পান ২৫০ টাকা করে।

কারিগর হেলাল জানান, মৌসুমে একজনের আয় মাসে গড়ে ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত হয়। কিন্তু মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দীর্ঘ অফ সিজনে আয় নেমে আসে মাত্র ১০ হাজার টাকায়। এই আয়ে পরিবার চালানো, কাঁচামাল কেনা এবং দৈনন্দিন ব্যয় মেটানো অনেক সময় অসম্ভব হয়ে পড়ে।

তিনি বলেন, “সিজনে যা আয় করি, তা দিয়ে পুরো বছরের খরচ চালানো যায় না। অফ সিজনে অন্য কোনো কাজ না পেলে খুব কষ্টে দিন কাটাতে হয়।” এই কারিগররা শুধু লেপ নয়, তোষক, বালিশ ও জাজিমও তৈরি করেন। একটি বালিশে ব্যবহার করা হয় প্রায় দেড় কেজি তুলা। তবে বালিশের বাজারদর কম হওয়ায় শ্রম অনুযায়ী লাভও কম।

লেপ-তোষক তৈরির মতো লোকজ কারুশিল্প বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতির এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তবে শিল্পটির স্থায়িত্ব এখন নানা চ্যালেঞ্জের মুখে। কাঁচামালের অস্থির বাজার, যন্ত্রনির্ভর পণ্যের প্রতিযোগিতা এবং অভাবনীয় অফ সিজন—সব মিলিয়ে ক্ষুদ্র কারিগরদের অবস্থা নাজুক হয়ে উঠছে।

হেলাল ও মিলনসহ স্থানীয় কারিগররা জানান “আমরা কারিগর। হাতের কাজ জানি। কিন্তু সারা বছর কাজ থাকে না। তাই সরকারের কাছে দাবি—অফ সিজনে যেন আমরা সুদমুক্ত ঋণ পাই। অথবা কোনো ছোটখাটো সরকারি কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করে দিলে আমরা পরিবার নিয়ে স্বস্তিতে থাকতে পারব।”

বাউফল প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি কামরুজ্জামান বাচ্চু বলেন, “এই পেশাকে টিকিয়ে রাখতে সরকারের উচিত লেপ–তোষক কারিগরদের জন্য বিশেষ বরাদ্দ রাখা, সিজনের বাইরে সুদমুক্ত ঋণের ব্যবস্থা করা এবং প্রশিক্ষণ ও বাজারসংযোগে সহায়তা দেওয়া। এতে যেমন একটি ঐতিহ্যবাহী পেশা টিকে থাকবে, তেমনি গ্রামীণ অর্থনীতিতেও নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।”

এ বিষয়ে বাউফল উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) আমিনুল ইসলাম বলেন, “লেপ–তোষক তৈরি এই অঞ্চলের একটি গুরুত্বপূর্ণ মৌসুমি পেশা। কারিগরদের সমস্যাগুলো আমরা অবহেলা করছি না। সরকারের বিভিন্ন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা সহায়তা কর্মসূচির মাধ্যমে কীভাবে তাদের অন্তর্ভুক্ত করা যায়, সে বিষয়ে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া হবে।

তিনি আরো বলেন, অফ সিজনে প্রশিক্ষণ, প্রণোদনা ও ক্ষুদ্রঋণ সুবিধা দেওয়ার বিষয়টিও পর্যবেক্ষণ করছি। স্থানীয় কারিগররা যেন এই পেশা টিকিয়ে রাখতে পারে, সেই লক্ষ্যে প্রশাসন সহযোগিতামূলক ভূমিকা রাখবে।”