শীতের আগমনীতে পটুয়াখালীসহ গোটা দক্ষিণাঞ্চলে ব্যস্ত এখন খেজুর রস সংগ্রহকারীরা। এ যেন প্রকৃতির কোমল স্পর্শে জেগে উঠেছে খেজুর গাছের অমৃত রস সংগ্রহকারীরা ।
গ্রামের পথে পথে গাছিরা ব্যস্ত, তাদের হাতে ধারালো দা, পিঠে ঝোলানো মাটির হাঁড়ি। ভোরের আলোয় তারা উঠে পড়ে গাছে, কেটে দেয় গাছের মগজ, যাতে ফোঁটা ফোঁটা রস ঝরে পড়ে রাতের নীরবতায়। এই রসের ঘ্রাণ মিশে যায় বাতাসে, মনকে মাতোয়ারা করে তোলে এক অপরূপ স্নিগ্ধতায়।
সকালের পাখির ডাকে শুরু হয় রস সংগ্রহের মহাযজ্ঞ। গাছিরা গাছের মাথায় চড়ে, দড়ি বেঁধে নিরাপদে ঝুলে থাকে, যেন তারা আকাশের সাথে মিলেমিশে একাকার। এক ফোঁটা রসও নষ্ট হয় না, হাঁড়িতে জমা হয় সেই সুমিষ্ট অমৃত। সন্ধ্যায় ফিরে এসে তারা গাছ পরিচর্যা করে, কেটে ফেলা অংশ বেঁধে দেয়, যাতে পরদিন আবার রসের ধারা বয়ে চলে।
প্রতিটি গ্রাম—থেকে অন্যান্য জনপদ—এখন রসের মহিমায় উদ্ভাসিত। রস থেকে তৈরি হয় লালি, তারপর গুড়—পাতলা ঝোলা, দানাদার, পাটালি। প্রতিটি গুড়ের টুকরোতে মিশে থাকে গাছির ঘাম, তাদের প্রাণের উষ্ণতা। শীত যত গভীর হয়, রস তত মিষ্টি, যেন প্রকৃতি নিজেই উপহার দেয় এই মধুর বরষণ।
কিন্তু এই মধুরতার পিছনে লুকিয়ে আছে এক গভীর উদ্বেগ। একসময় পথে, পুকুরপাড়ে, ক্ষেতের আইলে দাঁড়িয়ে থাকত অসংখ্য খেজুর গাছ। প্রতি বাড়িতে রসের হাঁড়ি ঝুলত, গুড় তৈরি হতো পরিবারের চাহিদা মিটিয়ে অতিরিক্ত। গ্রামীণ জীবনের সঙ্গী ছিল এই গাছ—পাতা থেকে পাটি, ডালপালা থেকে জ্বালানি।
এদিকে সময়ের বিবর্তনে, ইটভাটার লোভে, নির্বিচারে কাটা পড়েছে গাছগুলো। পরিবেশের সচেতনতার অভাব, জলবায়ু পরিবর্তনের ছোবল, বন বিভাগের নজরদারির অভাব—সব মিলিয়ে খেজুর গাছ বিলুপ্তির পথে।
যে গাছ দশ বছর রস দেয়, তার সংখ্যা দিন দিন কমছে। গ্রামবাংলার ঐতিহ্য হারিয়ে যাচ্ছে, যেন একটি সভ্যতার অংশ মুছে যাচ্ছে নীরবে।




Comments