ফের আলোচনায় টাঙ্গাইলের মধুপুর প্লেট; কোটি মানুষের মৃত্যুর শঙ্কা
ভৌগোলিক অবস্থার কারণে বাংলাদেশ বড় ধরনের ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে। বাংলাদেশের তিনটি প্রধান ভূমিকম্পন বলয়ের মধ্যে মধুপুরে একটি বলয় রয়েছে যা মধুপুর ফল্ট নামে পরিচিত। এ প্লেটের কারণে টাঙ্গাইলসহ সারাদেশে উচ্চ মাত্রায় ভূমিকম্পের আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশেষ করে টাঙ্গাইল জেলা ভূমিকম্পের উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন।
শুক্রবার ও শনিবার দেশে বেশ কয়েকবার ভূমিকম্পনের পর আবারো মধুপুর ফল্টের আলোচনায় নাম উঠে এসেছে। মধুপুর ফল্টে উচ্চ মাত্রায় ভূমিকম্প হলে বহু হতাহতের আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিগত সময়গুলোতে মধুপুর ফল্টে বেশ কয়েকটি ভূমিকম্প সংঘটিত হয়েছে। তবে মধুপুরের স্থানীয়দের দাবি ভূমিকম্পের বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোন সচেতনতা কার্যক্রম করা হয়নি।
এদিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মধুপুর ফল্টে ৬ থেকে সাড়ে ৬ মাত্রার ভূমিকম্প হলে টাঙ্গাইল ময়মনসিংহ, গাজীপুর ও ঢাকা প্রায় ১ কোটি মানুষের মৃত্যু হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
রাজধানী ঢাকা থেকে মধুপুর ফল্টের দূরুত্ব কম হওয়ায় আলোচনায় সর্বাধিক গুরুত্ব পাচ্ছে মধুপুর ফল্ট নিয়ে। ভূস্তরে মধুপুর টেকটোনিক বলতে যা বোঝায় তা শুধু মধুপুর উপজেলাকে বোঝায় না বরং মধুপুর গড়ের পুরো এলাকাকে বোঝায়। মধুপুর ফল্টের ভূমিকম্পের জন্য শুধু রাজধানী ঢাকা নয়, মধুপুর গড়াঞ্চলের টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ এবং গাজীপুরে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হবে। আর এ ভূচ্যুতি ঢাকার কাছে হওয়ায় এখানে ভূমিকম্প হলে রাজধানী ঢাকার খুব বেশি ক্ষয়ক্ষতি হবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, মধুপুর ফল্ট একটি সক্রিয় ফল্ট, যা যেকোনো সময় ভূমিকম্পের কারণ হতে পারে। ঢাকা থেকে মাত্র ১শ’ কিলোমিটার দূরে মধুপুর অঞ্চলে ৭ থেকে ৭.৫ মাত্রার ভূমিকম্প হবার মতো ভূতাত্ত্বিক ফাটল রেখা রয়েছে। এর ফলে ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, ঢাকাসহ আশপাশের অনেক জেলা ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে। গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি ভূমিকম্প আঘাত হেনেছে। এর মধ্যে কিছু ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল টাঙ্গাইলের মধুপুরে। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে টাঙ্গাইলে ৪.২ মাত্রার একটি ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল এই মধুপুর। মধুপুর উপজেলার গড় এলাকার বোকারবাইদ গ্রামের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে বক্রাকারে তিন থেকে চার ইঞ্চি ব্যাসার্ধের প্রায় আধা মাইল দীর্ঘ এ ভূ-ফাটল দেখা দিয়েছিল। এ ফাটলের গভীরতা ছিল ১৫ থেকে ২০ ফিট। এর আগে সর্বপ্রথম মধুপুর ফল্টে ১৮৮৫ সালে ৭ মাত্রার ওপরে ভূমিকম্প হয়েছিল।
২০১০ সালে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে পরিচালিত এক গবেষণায় বলা হয়, মধুপুর ফল্টে রিখটার স্কেলে ৭.৫ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ৭২ হাজার ৩১৬টি পাকা ভবন ধসে যেতে পারে এবং আংশিক ক্ষতি হতে পারে ৫৬ হাজার ১৬৬টি ভবনের।
২০০৮ থেকে ২০০৯ সালের মধ্যে পরিচালিত আরেক গবেষণায় বলা হয়, বাংলাদেশ সীমান্তে টেকটোনিক প্লেটের সীমানায় ৮.৫ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ঢাকা শহরের ২ লাখ ৩৮ হাজার ১৬৪টি ভবন ধসে পড়তে পারে।
এদিকে ভূমিকম্পের আশঙ্কার মধ্যেই অপরিকল্পিতভাবে টাঙ্গাইল শহরসহ আশেপাশে বিভিন্ন এলাকায় নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই একাধিক বহুতল ভবনের নির্মাণ করা হয়েছে এবং নির্মাণ কাজ চলছে। এতে করে ঝুঁকি বাড়ছে টাঙ্গাইল শহরে। এদিকে ভবনগুলো ১২, ১৪ থেকে ১৮ তলা পর্যন্ত নির্মিত হচ্ছে। ইতিমধ্যে অনেক বহুতল ভবনও নির্মাণ হয়েছে। আর এসব বহুতল ভবন একাধিক ডেভেলাপমেন্ট এন্ড কনস্ট্রাকশন লিমিটেড ও যৌথ মালিকানায় গড়ে ওঠা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করছে।
পৌরসভার আওতায় বহির্ভুত এলাকায় ভবনের ভারবহনের ক্ষমতা, যাচাইসহ এর স্থাপত্য, কাঠামোগত, বৈদ্যুতিক, মেকানিক্যাল, প্লাম্বিং, অগ্নিনিরাপত্তার নকশা অনুমোদন নিতে হয়। কিন্তু অধিকাংশ ভবনগুলো নকশার অনুমোদন নেই বলে অভিযোগ রয়েছে।
মধুপুরের বাসিন্দা ও জয়েনশাহী আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদের সাবেক সভাপতি অজয় বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে আমাদের কোন সচেতন করার ব্যাপারে কোন কার্যক্রম করেনি। মধুপুর ফল্টের ভূমিকম্প নিয়ে কেউ তেমন গুরুত্ব দিচ্ছে না। গতকালও আমরা ভূমিকম্পের ঝাঁকুনি পেয়েছি। আর কিছুক্ষণ থাকলে ক্ষয়ক্ষতি হতো।
তিনি আরো বলেন, আমরা শঙ্কিত রয়েছি। কারণ আমরা মধুপুর ফল্টের উপরেই বসবাস করছি। ভূমিকম্প নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে আমাদের সচেতন করতে হবে। বিগত সময়ে ভূমিকম্পে ফাটল দেখা দিয়েছিলো।
টাঙ্গাইলে ভূমিকম্পের বিষয়ে টাঙ্গাইলের মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনভারমেন্ট এন্ড রিসোর্স এন্ড সাইন্সের অধ্যাপক মীর মো. মোজাম্মেল হক বলেন, বাংলাদেশের তিনটি প্রধান ভূমিকম্পন বলয়ের মধ্যে মধুপুরে একটি বলয় রয়েছে যা মধুপুর ফল্ট নামে পরিচিত। মধুপুরের ফল্টের ব্যপ্তি টাঙ্গাইলসহ ময়মনসিংহ, গাজীপুর ও ঢাকার ১ কিলোমিটারের মধ্যে। গত দুইদিনেই ঢাকাও তার আশপাশেই এলাকায় ৩টি ভূমিকম্প হয়েছে। এছাড়াও ঢাকার আশপাশেই আরো কয়েকটি ভূমিকম্প হয়েছে। এতে আশঙ্কা করা হচ্ছে ঢাকা আশপাশে কিংবা মধুপুর ফল্টে যে কোন সময়ে বড় ধরনের ভূমিকম্প হতে পারে। মধুপুর ফল্ট যে কোন সময়ে সক্রিয় হতে পারে বলে আমরা শঙ্কার মধ্যে রয়েছি।
তিনি আরো বলেন, মধুপুর ফল্টে ৬ থেকে সাড়ে ৬ মাত্রার ভূমিকম্প হলে টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, গাজীপুর ও ঢাকার বিস্তীর্ণ অংশে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এতে প্রায় ১ কোটি মানুষের মৃত্যুর আশঙ্কা রয়েছে। ভূমিকম্প হবেই। এটি কন্টোল করার কোন উপায় নেই। তবে আমাদের সচেতন হতে হবে।
তিনি বলেন, ১৯৫০ সালে ময়মনসিংহ অঞ্চলে ভূমিকম্প হয়েছিল। যার ফলে ব্রক্ষ্মপুত্র নদ তার গতিপথ পরিবর্তন হয়ে নতুন ব্রক্ষ্মপুত্র তৈরি হয়েছিলো। এদিক থেকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় টাঙ্গাইল অঞ্চল ভূমিকম্প প্রবণ এলাকার মধ্যে পড়ে। ভূমিকম্পের উচ্চ ঝুঁকিতে আছে টাঙ্গাইল জেলা।
তিনি আরো বলেন, গত কয়েক বছর ধরে জেলায় বহুতল ভবন নির্মাণ হয়েছে। বিশেষ করে এসব বহুতল ভবনগুলো একটার সাথে আরেকটা প্রায় লাগনো অবস্থায় তৈরি করা হয়েছে। বড় ধরণের ভূমিকম্প হলে এসব ভবনগুলো ধ্বসে প্রচুর প্রাণহানীরও ঘটনা ঘটতে পারে।
এ ব্যাপারে মধুপুরের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জুবায়ের হোসেন বলেন, মধুপুর ফল্টের ভূমিকম্পের কারণে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার সম্ভবনা রয়েছে। মধুুপুর ফল্ট নিয়ে আমাদের কোন প্রস্ততি নেই বললেই চলে। দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ে বিষয়টি জানানো হবে। দুযোর্গ প্রশমন দিবসে ভূমিকম্পে পরবর্তীতে করণীয় বিষয়ে আমরা বিভিন্ন কার্যক্রম দেখিয়েছি। তবে স্থানীয়দের সচেতনার জন্য দ্রুতই মহড়া করা হবে।
এ প্রসঙ্গে টাঙ্গাইল ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সহকারী পরিচালক জানে আলম বলেন, ভূমিকম্পের জন্য টাঙ্গাইলের উত্তর অংশ রেড জোনে রয়েছে। জেলার মধ্যে মধুপুর, ভূঞাপুর, টাঙ্গাইল সদর, মির্জাপুর উপজেলার ৪টি স্টেশনগুলোতে সরঞ্জাম বেশি রয়েছে। ভূমিকম্পের বিষয় রেখে আমাদের প্রস্ততি চলছে। ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি উদ্ধারে আমাদের সমক্ষতা বেড়েছে। এছাড়াও আমরা কমিউনিটি ভলান্টিয়ার প্রস্তুত করছি। যারা ভূমিকম্প পরবতী চিকিৎসা সেবাসহ উদ্ধার অভিযানে সহায়তা করার সক্ষমতা অর্জন করেছে। এছাড়া ভূমিকম্পের পরবর্তী সময়ে মহড়া করা হচ্ছে।
তিনি আরো বলেন, বড় ধরনের ভূমিকম্পে হলে যদি রাস্তা ডেবে যায়, তাহলে আমাদের যাতায়েতের সমস্যা হবে। যারা আটকা পড়বে তাদের কিভাবে উদ্ধার করা যায় তা নিয়ে আমরা কাজ করছি। তার শহরে উঁচু ভবন তৈরি ক্ষেত্রে আমরা কঠোর ভূমিকা নেবো।




Comments