আজ ১০ ডিসেম্বর ভোলা পাক হানাদারমুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে ভোলা মুক্ত হয় দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর হাত থেকে। জাতীয় বিজয়ের ছয় দিন আগেই স্বাধীনতার স্বাদ পেয়েছিলো ভোলাবাসী। দিনটি উদযাপনে লাল-সবুজের পতাকা নিয়ে রাস্তায় নেমে আসে স্থানীয়রা।
ভোলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস থেকে জানা যায়, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল চাপের মুখে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কোনঠাসা হয়ে পড়ে। নিজেদের জীবন বাঁচাতে ১০ ডিসেম্বর হানাদার বাহিনী কার্গো লঞ্চ যোগে ভোলা থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। তাদের চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে মুক্ত হয় ভোলা।
পাকবাহিনী পালিয়ে যাওয়ার পর ১০ ডিসেম্বর সকালে বর্তমান ভোলা কালেক্টরেট ভবনের সামনের জেলা হিসাব রক্ষণ অফিসের ছাদে পতাকা উড়িয়ে ভোলাকে হানাদার মুক্ত ঘোষণা করেন মুক্তিযোদ্ধারা। পাকবাহিনী চলে যাওয়ার পর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মুক্তিযোদ্ধারা আশপাশ থেকে শহরে প্রবেশ করেন। শহরের ওয়াপদা, পাওয়ার হাউজ ও পরবর্তীতে জেলা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ক্যাম্প স্থাপন করে এবং শুরু হয় বিজয়ের আনন্দ মিছিল।
১৯৭১-এ দেশ রক্ষায় সারাদেশের ন্যায় ভোলাতেও চলে মুক্তিযুদ্ধ। ভোলা সরকারি স্কুল মাঠ, বাংলা স্কুল, টাউন স্কুল মাঠ ও ভোলা কলেজের মাঠের কিছু অংশে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। পরে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সম্মুখযুদ্ধ হয় ভোলার ঘুইংঘারহাট, দৌলতখান, বাংলাবাজার ও বোরহানউদ্দিনের দেউলা এবং চরফ্যাশন বাজারে। বিপুল সংখ্যক পাক সেনাকে হটিয়ে যুদ্ধে শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা শাহাদাত বরণ করেন। ভোলার খেয়াঘাট এলাকায় মুক্তিযোদ্ধারের ধরে এনে হত্যা করে তেঁতুলিয়া নদীতে ফেলে দেয়া হত। ওইসময় মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষের রক্তে লাল হয়ে যেত মেঘনা-তেঁতুলিয়া নদীর লোনা পানি।
এছাড়া বহু নারীকে ধরে এনে হানাদার বাহিনীর ক্যাম্পে আটকে রেখে রাতভর নির্যাতনের পর সকালে লাইনে দাঁড় করিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। ওই সময় হানাদার বাহিনী অগণিত মানুষসহ মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা করে গণকবর দিয়েছে।
পাক সেনারা পালিয়ে যাওয়ার পর ভোলার ওয়াপদা থেকে ৩০ জন বীরঙ্গনাকে উদ্ধার করা হয়। চিকিৎসা শেষে পরিবারের কাছে তাদের পৌঁছে দেয়া হয়।
স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ভোলা শহরের পানি উন্নয়ন বোর্ড অফিস চত্বর দখল করে পাক-হানাদার বাহিনী ক্যাম্প স্থাপন করে। সেখান থেকে চালায় নানান পৈচাশিক কর্মকাণ্ড। মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিকামী নিরীহ মানুষদের ধরে এনে হত্যা করা হয়। ওয়াপদা ভবনের পেছনে গণকবর দেয়া হয়। সেটি এখন বধ্যভূমি। এছাড়াও ভোলার বাংলা বাজারে ১৯৭১ সালের ২৭ অক্টোবর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মুখযুদ্ধ হয়। এসময় অনেক মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
ওই সময় ভোলা সদরের গুইংগারহাট, দৌলতখানের গুপ্ত বাজার, বোরহানউদ্দিনের দেউলাতে বিরামহীন সম্মুখযুদ্ধ হয়। এসব বধ্যভূমি ও সম্মুখযুদ্ধের রণাঙ্গনের স্থানগুলোর মধ্যে শুধু মাত্র ভোলার পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বধ্যভূমি ও বাংলা বাজারে মুক্তিযুদ্ধের স্থান সংরক্ষণ করা হয়েছে। এছাড়া ভোলা বাংলা বাজারে মুক্তিযুদ্ধের স্থান সংরক্ষণের কাজ হলেও অন্যান্য বধ্যভূমি ও মুক্তিযুদ্ধের স্থানগুলো এখনো সংরক্ষণ করা হয়নি।
মুক্তিযোদ্ধাসহ স্থানীয় মানুষেরা বধ্যভূমি ও মুক্তিযুদ্ধের স্থানগুলো সংরক্ষণের দাবি জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি।
মুক্তিযোদ্ধারা ভোলার অধিকাংশ এলাকা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে যখন শহর নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রস্তুতি নেন, ঠিক সেই সময় ১০ ডিসেম্বর ভোররাতে পাকিস্তানি হানাদাররা চারদিকে গুলি ছুড়তে থাকে। তখন মুক্তিযোদ্ধা কাজী জয়নাল ও ফিরোজের নেতৃত্বে ১৩ জনের একটি বাহিনী তাদের পেছন থেকে ধাওয়া করলে হানাদাররা ভোর ৫টায় ভোলার পুরান লাশ কাটা ঘরের পাশে রাখা একটি কার্গো লঞ্চে চড়ে ভোলা থেকে পালিয়ে যায়। ওই সময় তাদের গতিরোধ করার জন্য খালে গাছ ফেলে ব্যারিকেডও দিয়েছিল মুক্তিকামী জনতা। পাক হানাদারদের বহনকারী ওই কার্গো লঞ্চটি মিত্রবাহিনীর বোমা বর্ষণের ফলে চাঁদপুরের মেঘনায় ডুবে হানাদার বাহিনীর অধিকাংশ সদস্যের মৃত্যু ঘটে বলে জানা যায়।
বীর মুক্তিযোদ্ধা আলম নিরব জানান, ১৯৭১ সালের ৬ মে দুপুর ১২ টায় বরিশাল থেকে লঞ্চযোগে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ভোলার খেয়াঘাটে এসে নামে। এ সময় তৎকালীন ভোলা পৌরসভার চেয়ারম্যানসহ শহরের একটি গ্রুপ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে স্বাগত জানিয়ে শহরে নিয়ে আসে। খেয়াঘাট থেকে সবাই পায়ে হেঁটে ভোলার যুগিরঘোল নামক এলাকার ওয়াপদা কলোনীতে গিয়ে পৌঁছে। এ খবর ছড়িয়ে পড়তে না পড়তে শহরের প্রায় সব বাড়িঘর ফাঁকা হয়ে যায়। এদিকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ট্রাক নিয়ে শহরের রাস্তায় রাস্তায় টহল দিতে থাকে।
এদিকে আজ ১০ ডিসেম্বর যথাযথ মর্যাদায় দিবসটি পালনে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বর্ণাঢ্য র্যালি, আলোচনা সভাসহ বিভিন্ন কর্মসূচির আয়োজন করা হয়েছে।




Comments