Image description

শরীয়তপুরে শীতকালীন ফসলের মৌসুমে কৃষকেরা সারের তীব্র সংকটে পড়েছেন। ইউরিয়া, টিএসপি, ডিএপি ও এমওপি—এই চারটি প্রধান সার কৃষকদের চাহিদার তুলনায় কম বরাদ্দ পাওয়ায় অনেক কৃষক বাধ্য হয়ে দূরবর্তী বাজার থেকে অতিরিক্ত মূল্যে সার কিনতে বাধ্য হচ্ছেন। এই পরিস্থিতি কেবল কৃষকের উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি করছে না, বরং আসন্ন ফসলের ফলন ও বাজার মূল্য স্থিতিশীলতাকেও অনিশ্চিত করছে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, শরীয়তপুর জেলার ছয়টি উপজেলায় মোট ৮২ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে বিভিন্ন ধরনের ফসলের আবাদ হয়ে থাকে। সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর—এই চার মাসকে শরীয়তপুরের কৃষিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এ সময় শীতকালীন শাকসবজি, আলু, পেঁয়াজ, রসুন, ডাল, তেলজাতীয় ফসল, মসলা ফসল, রবিশস্য, ধানের বীজতলা ও বিভিন্ন জাতের ধানের আবাদে মাঠজুড়ে ব্যস্ত থাকেন কৃষকেরা।

এই মৌসুমের জন্য কৃষি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো চাহিদা অনুযায়ী শরীয়তপুরে ইউরিয়া প্রয়োজন ছিল ১৮ হাজার ৫৯৫ মেট্রিক টন, টিএসপি ৪ হাজার ৮১০ মেট্রিক টন, ডিএপি ১২ হাজার ৭৭৫ মেট্রিক টন এবং এমওপি ৮ হাজার ৯৯২ মেট্রিক টন। কিন্তু বরাদ্দ পাওয়া গেছে তার তুলনায় অনেক কম। জেলায় ইউরিয়া বরাদ্দ এসেছে মাত্র ৭ হাজার ৯৪৬ মেট্রিক টন, টিএসপি ১ হাজার ৭২৭ মেট্রিক টন, ডিএপি ৭ হাজার ৭৫ মেট্রিক টন এবং এমওপি মাত্র ২ হাজার ২১৯ মেট্রিক টন।

এ হিসাবে এ মৌসুমে শরীয়তপুরে ইউরিয়া সারের ঘাটতি ৫৭ শতাংশ, টিএসপির ঘাটতি ৬৪ শতাংশ, ডিএপির ঘাটতি ৪৪ শতাংশ এবং এমওপি সারের ঘাটতি সর্বোচ্চ ৭৫ শতাংশ।

সরকার কৃষকদের জন্য সার সহজলভ্য করতে প্রতিটি ইউনিয়নে একজন করে মোট ৭১ জন ডিলার নিয়োগ দিয়েছে। সরকার–নির্ধারিত দামে প্রতি কেজি ইউরিয়া ও টিএসপি ২৭ টাকা, ডিএপি ২১ টাকা এবং এমওপি ২০ টাকায় বিক্রির কথা থাকলেও বাস্তবে তার চিত্র ভিন্ন। সরবরাহ কম থাকায় ডিলার ও তাদের নিয়ন্ত্রিত খুচরা বিক্রেতারা বর্তমানে প্রতি কেজি সার ১০ থেকে ১২ টাকা পর্যন্ত বেশি দামে বিক্রি করছেন বলে অভিযোগ কৃষকদের।

কৃষকেরা জানান, গড়ে প্রতি শতাংশ জমিতে বিভিন্ন ফসলের জন্য প্রায় তিন কেজি সার প্রয়োজন হয়। সরকার নির্ধারিত দামে যেখানে এর খরচ ৮০–৮২ টাকা হওয়ার কথা, সেখানে এখন কৃষকদের ১১০ থেকে ১২০ টাকা পর্যন্ত গুনতে হচ্ছে। অর্থাৎ প্রতি শতাংশ জমিতে ৩০ থেকে ৪০ টাকা অতিরিক্ত ব্যয় হচ্ছে, যা সামগ্রিক উৎপাদন খরচ উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়িয়ে দিচ্ছে।

জাজিরা উপজেলার বড়কান্দি এলাকার কৃষক আবুল বেপারী বলেন, তিনি ১৪০ শতাংশ জমিতে শীতকালীন শাকসবজি, পেঁয়াজ ও রসুনের আবাদ করেছেন। এসব ফসলের জন্য তাঁর সারের প্রয়োজন ছিল প্রায় ২০ হাজার টাকা। কিন্তু বাজারে সংকট থাকায় তাঁকে সাড়ে ছয় হাজার টাকা অতিরিক্ত ব্যয় করে সার কিনতে হয়েছে। 

তিনি বলেন, ‘ডিলারের কাছে গেলে বলে সার নাই। ফসল তো মাঠে আছে, সার না দিলে ফলন হবে না। তাই বাধ্য হয়ে বেশি দাম দিয়ে কিনেছি।’

একই উপজেলার ডুবলদিয়া এলাকার কৃষক হারুন মাদবর বলেন, ‘শর্ষে, ধনিয়া, কালিজিরা, পেঁয়াজ আর রসুন আবাদ করেছি। সব সারের দামই বেশি। আমরা কৃষক, কিন্তু আমাদের কষ্ট কেউ বোঝে না। সার আর শ্রমিকের দাম বাড়ে, কিন্তু ফসল বিক্রি করতে গেলে ন্যায্য দাম পাই না।’

কৃষি কর্মকর্তারা জানান, স্থানীয় কৃষি বিভাগ থেকে সারা বছরের চাহিদা নিরূপণ করে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। পরে জেলা প্রশাসনের নেতৃত্বে মাসভিত্তিক বরাদ্দ বণ্টন করে ইউনিয়ন পর্যায়ের ডিলারদের মধ্যে তা সরবরাহ করা হয়। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি), বিসিআইসি এবং বেসরকারি আমদানিকারকেরা এসব সার ডিলারদের কাছে পৌঁছে দেন।

বিএডিসির ফরিদপুর অঞ্চলের যুগ্ম পরিচালক এস এম ইকরামুল হক বলেন, ‘টিএসপি, ডিএপি ও এমওপি বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। বরাদ্দের তালিকা অনুযায়ী আমরা সরবরাহ দিয়ে থাকি। কোনো জেলায় ঘাটতি হলে মন্ত্রণালয়ে উপবরাদ্দ চাইতে পারে।’

শরীয়তপুর সার বিক্রেতা সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবদুর রব হাওলাদার বলেন, ‘আমরা যে পরিমাণ বরাদ্দ পাই, তা নির্ধারিত দামেই বিক্রি করি। তবে কখনো সরবরাহ কম থাকলে খুচরা পর্যায়ে কিছু অসঙ্গতি দেখা দেয়।’

শরীয়তপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মোস্তফা কামাল হোসেন বলেন, ‘চাহিদার তুলনায় বরাদ্দ কম—এটা সত্য। বেশি দামে সার বিক্রি ঠেকাতে মনিটরিং জোরদার করা হয়েছে। প্রশাসনের সহায়তায় ভ্রাম্যমাণ আদালতও কাজ করছে। কৃষকদের সুষম মাত্রায় সার ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।’

ভরা মৌসুমে সারের এমন সংকট অব্যাহত থাকলে কৃষি উৎপাদন, কৃষকের আয় ও খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থায় নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে—এমন আশঙ্কাই এখন শরীয়তপুরের মাঠে মাঠে।