Image description

ঝুঁকিকে সঙ্গী করেই চলে তাঁর প্রতিদিনের লড়াই। কখনো মৌমাছির হুল, কখনো বা অনিশ্চিত আয়ের ভয়—সবকিছুকে উপেক্ষা করে প্রাকৃতিক মধুই তাঁর জীবিকার একমাত্র ভরসা। তিনি আব্দুল বারিক, বাড়ি খুলনার পাইকগাছা উপজেলার মটবাটি গ্রামে। তবে পুরো এলাকায় তিনি ‘মধু বারিক’ নামেই পরিচিত। দীর্ঘ দুই যুগের বেশি সময় ধরে প্রাকৃতিক মৌচাক থেকে মধু সংগ্রহ করেই তিনি সচল রেখেছেন সংসারের চাকা।

বারিক জানান, গ্রামের বিভিন্ন গাছ, বাগান ও বসতবাড়িতে প্রাকৃতিকভাবে তৈরি হওয়া মৌচাক থেকেই তিনি মধু সংগ্রহ করেন। তবে বছরের সব দিন মধু মেলে না। সাধারণত ফাল্গুন থেকে আষাঢ় মাস পর্যন্ত মধু পাওয়া যায়। এর মধ্যে বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ মাস মধুর ভরা মৌসুম। এ সময় গাছে গাছে ফুল ফোটে, আর মৌমাছিরাও চাকে মধু জমায়। বছরের বাকি সময়টা কাজ অনেকটাই কমে যায়।

বর্তমানে বাজারে ভেজাল মধুর ভিড়ে খাঁটি মধু পাওয়া দুষ্কর। তাই ভেজালমুক্ত মধুর জন্য স্থানীয়দের কাছে আস্থার প্রতীক হয়ে উঠেছেন মধু বারিক। অনেক সময় তিনি ক্রেতাদের সামনেই গাছ থেকে চাক কেটে মধু সংগ্রহ করে দেন। কেউ চাইলে চাকসহ মধুও কিনে নেন। এতে খাঁটি মধু নিয়ে আর কোনো সন্দেহের অবকাশ থাকে না।

নিজের অভিজ্ঞতার ঝুলি খুলে বারিক বলেন, “প্রায় ২০-২৫ বছর ধরে এই কাজ করছি। সাধারণত চাকের মালিকের সঙ্গে অর্ধেক-অর্ধেক ভাগে মধু বণ্টন হয়। প্রতি কেজি মধু ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা দরে বিক্রি করি।” তবে কেবল মধু দিয়ে সংসার চলে না, প্রয়োজনে অন্য কাজও করতে হয় তাকে।

মধু সংগ্রহ মোটেও সহজ কাজ নয়, এটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। বারিক জানান, চাক কাটার আগে খড় ও শুকনো পাতা দিয়ে মশালের মতো আগুন জ্বালানো হয়, যাকে স্থানীয় ভাষায় ‘বোলেন’ বা ‘বুন্দা’ বলা হয়। ওই আগুনের ধোঁয়ায় মৌমাছিরা চাক ছেড়ে সরে গেলে দা বা কাঁচি দিয়ে চাক কেটে বালতিতে নেওয়া হয়। পরে হাত দিয়ে চিপে মধু আলাদা করা হয়। ভবিষ্যতে যাতে মৌমাছিরা আবার চাক বাঁধতে পারে, সে জন্য চাকের কিছু অংশ গাছে রেখে দেওয়া হয়।

চাক মধুতে পূর্ণ হয়েছে কি না, তা দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা থেকেই বোঝেন বারিক। তিনি বলেন, “চাকের ওপরের অংশ ভারী আর নিচের অংশ সরু হয়ে গেলে বুঝি মধু জমেছে।” একসময় তিনি সুন্দরবনের মৌয়ালদের সঙ্গেও মধু আহরণ করেছেন। সুন্দরবনসংলগ্ন উপকূলীয় এলাকায় বড় বা দাশ মৌমাছির চাক বেশি পাওয়া যায় বলে জানান তিনি।

তবে জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে এই পেশায়। বারিক জানান, তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও অনিয়মিত বৃষ্টিপাতের কারণে অনেক গাছেই এখন ঠিকমতো ফুল থাকছে না, ঝরে যাচ্ছে। ফলে আগের মতো আর মধু জমছে না। পর্যাপ্ত মৌচাক না পাওয়ায় মাঝেমধ্যেই সংসার চালাতে তাকে হিমশিম খেতে হয়।

এতসব ঝুঁকি, অনিশ্চয়তা আর সীমাহীন পরিশ্রমের মাঝেও মৌচাকের মধুতেই বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখেন আব্দুল বারিক। তাঁর সংগৃহীত প্রতিটি ফোঁটা মধুতে মিশে আছে একজন সংগ্রামী মানুষের টিকে থাকার নীরব গল্প।

মানবকণ্ঠ/ডিআর