Image description

২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর কক্সবাজার রামুতে ফেসবুকে ধর্মগ্রন্থ অবমাননার অভিযোগে সম্প্রীতি, ঐতিহ্য বিনষ্টের ভয়াল এক রাতের বিভীষিকাময় ঘটনা ঘটে। এ ভয়াবহ ঘটনার অভিযোগের মূল কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের রামুর হাইটুপী (শ্রীকুল) গ্রামের যুবক উত্তম বড়ুয়া। 

ঐ ঘটনার সার্বজনীনভাবে অভিযুক্ত উত্তম বড়ুয়া চারিদিকে হৈচৈ শুরু হওয়ার পর থেকে নিজেকে আড়াল করে, এক অজানা অন্ধকারে হারিয়ে গিয়েছিল। দীর্ঘ ১৩ বছর ১৩ দিন পর অবশেষে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তার খোঁজ মিলেছে। 

গতকাল( ১৪ অক্টোবর) বাংলাদেশ সময় রাত ১০টার দিকে ফ্রান্সের একটি বিমানবন্দরের লাউঞ্জে তার স্ত্রী রীতা বড়ুয়া ও একমাত্র সন্তান আদিত্যকে সঙ্গে নিয়ে তোলা উত্তম বড়ুয়ার একটি ছবি  সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।

সে সময় থেকে আবারো আলোচনায় আসে 'রামু সহিংসতার' মূল অভিযুক্ত উত্তম বড়ুয়া। ২০১২ সালের 'রামু সহিংসতার' পর থেকে সে পলাতক ছিল।

তার পরিবার ছাড়া উত্তম বড়ুয়া কোথায় আছে কেউ জানতো না।
উত্তমের বাবা সুদত্ত বড়ুয়া ও মা মাধু বড়ুয়া জানান, ঘটনার পর থেকে উত্তম কোথায় আছে জানতো না, আমরা অপেক্ষায় ছিলাম ছেলে একদিন ফিরে আসবেন। আমাদের সে ইচ্ছেটা পূরণ হয়েছে। এখন ছেলে তার স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ফ্রান্সে ভালো আছে।

২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর কক্সবাজার রামুর বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী উত্তম কুমার বড়ুয়া নামের এ যুবকের ফেসবুকে অপর একটি ফেসবুক আইডি থেকে পবিত্র কোরআন শরীফ অবমাননাকর ছবি ট্যাগ করা হয়।

রামু ফকিরা বাজারের ‘ফারুক কম্পিউটার’ নামের একটি দোকানে উত্তম বড়ুয়ার ফেসবুকে পবিত্র কোরআন অবমাননাকর ছবিটি দেখেন, চট্টগ্রাম পলিটেকনিক কলেজের ছাত্র মুক্তাদির। ছবি দেখার পর মুহুর্তের মধ্যে শত শত কপি প্রিন্ট প্রচার করা হয়। ছবি প্রচারের পর পরই রামু বাজার এলাকা ও মন্ডলপাড়ার বেশ কয়েকজন স্থানীয় বিগত সরকার সমর্থিত নেতার নেতৃত্বে বের হয় রামুর বিভিন্ন এলাকা থেকে শতশত বিক্ষোভ মিছিল।

পরবর্তীতে স্থানীয় জনতা ও দুষ্কৃতিকারীরা উত্তেজিত হয়ে মিছিল-সমাবেশ করে রামুর বিভিন্ন বৌদ্ধ পল্লীতে বৌদ্ধ বিহার ও বসতবাড়ীতে হামলা, ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট চালায়। এসময় রামুর বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের কয়েকশ বছরের ১২টি বৌদ্ধ বিহার, ২৬টি বসতঘরসহ প্রায় শতাধিক দোকান পুড়িয়ে দেওয়া হয়। পরদিন উখিয়া-টেকনাফের আরো ৭টি বৌদ্ধ বিহারেও অগ্নিসংযোগ, হামলা ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে।

সে সময়ে দফায় দফায় ভাংচুর অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট চালিয়ে রামুর ধর্মীয় সম্প্রীতির শত বছরের ঐতিহ্য ও রামুর বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের প্রায় ৩০০/৪০০ শত বছরের পুরোনো প্রত্নতাত্তিক নিদর্শন ধ্বংস হয়ে যায়, বিভীষিকাময় সেই ভয়াল রাতে নিমিষেই শেষ হয়ে যায়। ধ্বংসযজ্ঞের বৌদ্ধ বিহারের দূর্লভ সংগ্রহশালায় ছিল মহামতি গৌতম বুদ্ধের দেহাবশেষ (ধাতু), তাল পাতার উপর বাংলা, ইংরেজি, পালি ও বার্মিজ- এই চার ভাষায় লেখা পাঁচ হাজারেরও বেশী ত্রিপিটক ও পূঁথি গ্রন্থ সংরক্ষিত ছিল সহিংস ঘটনায় পুড়ে যাওয়া রামু কেন্দ্রীয় সীমা বিহারের সংগ্রহশালায়। এখানে আরো ছিল স্বর্ণ-রোপ্য,কষ্টি পাথর, শ্বেতপাথর, চন্দন কাঠের তৈরি চার শতাধিক বুদ্ধমূতি। এ সংগ্রহ শালায় এমনও কিছু গ্রন্থ ছিল যা রামু ছাড়া বাংলাদেশে বিরল। 

বৌদ্ধধর্মের গবেষকদের মতে, ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে দুস্কৃতিকারীদের তান্ডবে নিমিষে পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া এসব প্রাচীন সাংস্কৃতিক সম্পদ। ঐতিহ্যগত দিক বিবেচনা করলে এসব সংগ্রহ অমূল্য।

রামুর এ সহিংসতার ঘটনায় উত্তম বড়ুয়াকে প্রধান অভিযুক্ত করে, জেলায় ১৯ টি মামলা হয়েছিল। তন্মধ্যে রামু থানায় ৮টি, উখিয়া থানায় ৭টি, টেকনাফ থানায় ২টি ও কক্সবাজার থানায় ২টি মামলা দায়ের করা হয়েছিল। সবকটি মামলায় আসামি করে ১৫ হাজার ১৮২ জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছিলো। এসব মামলায় আটক হয়েছিলো ৫২৬ জন। তবে আটককৃতরা সবাই জামিনে রয়েছেন।