Image description

জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) মাদারীপুর জেলা শাখার সদস্য মেরাজুল ইসলামের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগের পাহাড় জমা হয়েছে। মামলা বাণিজ্য, নারীদের অনৈতিক প্রস্তাব, পরকীয়া, এবং পুলিশ দিয়ে হয়রানিসহ অসংখ্য অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে। সম্প্রতি তার অনৈতিক কর্মকাণ্ডের অশ্লীল কথোপকথনের ভিডিও, কল রেকর্ড এবং ছবি ফাঁস হওয়ায় এলাকাবাসীর মধ্যে তীব্র ক্ষোভ ও নিন্দার ঝড় বইছে। রাজৈর উপজেলার শংকরদী গ্রামের ফার্নিচার পলিশ মিস্ত্রি সিরাজ বেপারীর ছেলে এই মেরাজুল।

এছাড়াও, বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে অনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন, ব্ল্যাকমেইল করে অর্থ আত্মসাৎ এবং হুমকির অভিযোগ এনে এক ভুক্তভোগী নারী সেনাবাহিনীর কাছে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন। উল্লেখ্য, টাকা চুরি ও নারী কেলেঙ্কারির অভিযোগে মেরাজুল ইতিপূর্বে পরপর চারটি কিন্ডারগার্টেন স্কুলের শিক্ষক পদ থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন। বর্তমানে তিনি এনসিপিতে যোগ দিয়ে অবৈধ বালু ব্যবসার এক শক্তিশালী সিন্ডিকেট পরিচালনা করছেন।

ফাঁস হওয়া ৬ মিনিট ৫৫ সেকেন্ডের একটি ভিডিও কল রেকর্ডে মেরাজুল ইসলামকে এক নারীর সঙ্গে তার অনৈতিক শারীরিক সম্পর্ক নিয়ে অশ্লীল ভাষায় কথা বলতে শোনা যায়। এ সময় তিনি অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে ওই নারীকে কথা বলতে বাধ্য করেন এবং হুমকিও দেন। একপর্যায়ে অসহ্য হয়ে ওই নারী কলটি কেটে দেন।

অনুসন্ধান ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মেরাজুল থ্রি-ডি ডিজিটাল স্কুল, ইকরা স্কুল, কিডস ইন্টারন্যাশনাল স্কুল ও মডেল স্কুল থেকে টাকা চুরি ও নারী কেলেঙ্কারির অপকর্মে জড়িত থাকার কারণে বহিষ্কৃত হয়েছেন। এসব প্রতিষ্ঠানে তিনি প্রতিষ্ঠানের টাকা আত্মসাৎ এবং নারীদের কুপ্রস্তাব দেওয়াসহ অনৈতিক সম্পর্কে জড়িত থাকার অভিযোগে অভিযুক্ত।

গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর রাজনৈতিক সুযোগ কাজে লাগিয়ে মেরাজুল জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপিতে যোগদান করেন এবং মাদারীপুর জেলা সমন্বয় কমিটির সদস্য পদ লাভ করেন। এরপর তিনি নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের সিন্ডিকেট পরিচালনা শুরু করেন। অবৈধ ড্রেজার বালু বিক্রিতে বাধা দেওয়ায় তিনি হামলার ঘটনাও ঘটিয়েছেন। বর্তমানে রাজৈর উপজেলার তাতিকান্দা, শংকরদী, হোসেনপুর ও পাইকপাড়াসহ বিভিন্ন নদীবেষ্টিত এলাকায় তার বালু বাণিজ্য চলছে।

গোপালগঞ্জ সদর থানায় মিথ্যা অভিযোগপত্রে নাম ঢুকিয়ে মামলার ভয় দেখিয়ে মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার বিভিন্ন নেতাকর্মীর কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা দাবির অভিযোগও পাওয়া গেছে এনসিপি নেতা মেরাজুল ইসলাম ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে। নাম কাটানোর কথা বলে তিনি রাজৈর উপজেলার হোসেনপুর ইউনিয়নের ইউপি সদস্য মোখলেস মিনার কাছে মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করেন।

ইতোমধ্যে ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এনসিপি নেতা মেরাজুল ইসলামের পরকীয়ার অশ্লীল ভিডিও কল রেকর্ড ও কিছু অশ্লীল ছবি ফাঁস হওয়ায় ভুক্তভোগী নারীরা মুখ খুলতে শুরু করেছেন।

ভুক্তভোগী এক নারী তার লিখিত অভিযোগে জানান, এনসিপি সদস্য মেরাজুল মাদক ব্যবসা ও সেবন করেন। তার সঙ্গে ভুক্তভোগী নারীর দীর্ঘ তিন বছরের প্রেমের সম্পর্ক ছিল। বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে মেরাজুল তার সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্কে জড়ান। একবার তার বাসায় এলে সুযোগ বুঝে ওই নারীর মোবাইল থেকে মেরাজুলের মোবাইলে গোপন ছবি নিয়ে যায়। পরে সেই ছবি ব্যবহার করে ব্ল্যাকমেইল করে দুই লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়। এরপর আবার ব্ল্যাকমেইল করে টাকা দাবি করে এবং ওই নারীকে বিভিন্ন স্থানে যাওয়ার জন্য হুমকি দেয়। এসব অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে ভুক্তভোগী নারী প্রথমে রাজৈর থানায় ও পরে সেনা ক্যাম্পে অভিযোগ দায়ের করেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক ভুক্তভোগী নারী জানান, তার সন্তান থ্রি-ডি ডিজিটাল স্কুলের (কিন্ডারগার্টেন) শিক্ষার্থী। মেরাজুল ওই স্কুলের শিক্ষক থাকাকালীন রাতে তার মোবাইলে কল দিতেন। একদিন বিরক্ত হয়ে তিনি তার বাবার কাছে ফোন ধরিয়ে দেন। পরে তার বাবা স্কুল কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানালে মেরাজুলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়।

এ বিষয়ে থ্রি-ডি ডিজিটাল স্কুলের পরিচালক আরিফুজ্জামান টিপু বেগ বলেন, "আমাদের স্কুলের টাকা চুরি ও নারীঘটিত কেলেঙ্কারি—এই দুটি প্রধান অপরাধের জন্য মেরাজুলকে স্কুল থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। পরবর্তীতে একই কার্যকলাপ করার অপরাধে আরও তিনটি কিন্ডারগার্টেন স্কুল থেকেও তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে।"

তিনি আরও বলেন, "২০২৩ সালে মেরাজুলকে স্কুলের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এ সুযোগে তিনি অভিভাবকদের কাছ থেকে টাকা তুলে নিজের কাছে রেখে দিতেন এবং হিসাবরক্ষকের কাছ থেকে হিসাবের খাতা চুরি করে লিখে রাখতেন। এভাবে প্রায় ৪০ হাজার টাকা চুরি করেন। পরে ধরা পড়ে গেলে আমাদের হাতে-পায়ে ধরে মাফ চান এবং আবার তাকে চাকরিতে নেওয়া হয়; কিন্তু পরবর্তীতে আবারও একই কাজ করেন। এছাড়া মেরাজুলের বিরুদ্ধে অভিভাবকদের বিভিন্ন নালিশ আসত। যেসব ছাত্রছাত্রীদের বাবারা প্রবাসে থাকতেন, সেই সব মহিলাদের টার্গেট করতেন এবং তার ফাঁদে কেউ পা দিলে অনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তুলতেন।"

রাজৈরের হোসেনপুর ইউনিয়নের ইউপি সদস্য মোখলেস মিনাকে মামলায় নাম ঢুকিয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে টাকা দাবি করেন এনসিপির সদস্য মেরাজুল ও তার লোকজন। তিনি মোবাইল ফোনে ঘটনাটির সত্যতা জানালেও সাংবাদিকদের সামনে ভয়ে কথা বলতে রাজি হননি।

তবে একটি কল রেকর্ডে ইউপি সদস্য মোখলেস মিনাকে বলতে শোনা যায়, "এনসিপির লোকজন একটা তালিকা করছে। যদি টাকাপয়সা দেই তাহলে সেই তালিকা থেকে নাম কাইটা দেবে, এইভাবে কথা বলে। গোপালগঞ্জের মামলায় নাম ঢুকাই দিতে চায়। মেরাজ এইগুলা নিয়ে বেশি করতেছে। তার সাথে আরও কয়েকজন আছে কিন্তু তাদের চিনি না। হেরা নাম দিয়া আবার কয় তোমরা কেউর কাছে এসব বিষয় আলোচনা করবা না, এইটা যার যার পারসোনাল নাম্বার। চেয়ারম্যানের নাম ঢুকায় আমাগো দুই-একজন মাদবার আছে তাগো নাম ঢুকায়, একটা তালিকা কইরা ধান্দা খোঁজে। দিন তো এমন থাকবে না, আমাগো দিনও আসবে।"

এ ব্যাপারে সকল অভিযোগ অস্বীকার করে মাদারীপুর জেলা এনসিপির সদস্য মেরাজুল ইসলাম বলেন, "কিন্ডারগার্টেন স্কুল, নারীদের কুপ্রস্তাব, অবৈধ বালু ব্যবসা ও মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়ার কথা বলে টাকা নেওয়ার বিষয়গুলোর মধ্যে কোনটাই সত্য না। সব জায়গায় আপনারা খোঁজ নিয়ে দেখতে পারেন। যদি কেউ বলতে পারে তাহলে আমি মেনে নেব।"

তবে ফাঁস হওয়া অনৈতিক সম্পর্কের ভিডিও রেকর্ডের বিষয়ে তিনি বলেন, "আমার একটা ফোন হারাই গেছে। ওই ফোনে কি ছিল না ছিল তা আমি জানি না।"

মাদারীপুর জেলা এনসিপির যুগ্ম সমন্বয়কারী আজগর শেখ বলেন, "এনসিপি দিন দিন বড় হচ্ছে। এখানে কিছু সুবিধাভোগী লোক তার স্বার্থ উদ্ধারের জন্য যোগ দিচ্ছেন। তবে মেরাজের (মেরাজুল ইসলাম) বিরুদ্ধে যদি কোনো অভিযোগ পাই, তাহলে কেন্দ্রকে অবগত করা হবে এবং ব্যবস্থা নেওয়া হবে।"

রাজৈর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মাহফুজুল হক বলেন, "এনসিপি নেতার বালু উত্তোলনকে কেন্দ্র করে এর আগে একটি মারামারির ঘটনা ঘটেছিল। বিষয়টি অবগত আছি। পাইকপাড়া থেকেও অবৈধ বালু উত্তোলনের অভিযোগ পেয়েছি। খবর পেলেই ব্যবস্থা নেব। কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।"

মাদারীপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অবস) জাহাঙ্গীর আলম বলেন, "মিথ্যা হয়রানির বিষয়ে অভিযোগ পেলে মামলা নেওয়া হবে।"