নওগাঁর মান্দা উপজেলার ভালাইন ইউনিয়নের চকশ্রীকৃষ্ণ গ্রামে সরকারি রাস্তা দখল এবং জনসাধারণের চলাচলে দীর্ঘ সাত দশকের দুর্ভোগের অবসান না হওয়ায় চরম ক্ষোভ বিরাজ করছে। গ্রামের শতাধিক পরিবারকে জিম্মি করে সম্প্রতি স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) অর্থায়নে নির্মিত রাস্তাটিও গ্রাস করেছে স্থানীয় একটি প্রভাবশালী চক্র। রাস্তা দখল করে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ এবং এর প্রতিবাদকারীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়ের করায় ক্ষুব্ধ এলাকাবাসী শনিবার (১১ অক্টোবর) শিবনদীর পূর্ব তীরে নবনির্মিত রাস্তায় এক বিশাল মানববন্ধন করেছে।
সাত দশকের বঞ্চনা, অসহায় গ্রামের জীবনযাত্রা
মানববন্ধনে উপস্থিত গ্রামের প্রবীণ ব্যক্তিরা বলেন, চকশ্রীকৃষ্ণ গ্রামের মানুষ প্রায় সাত যুগ ধরে রাস্তাবিহীন জীবনযাপন করছে। হাঁটার উপযোগী সামান্য পথটুকুই ছিল একমাত্র ভরসা। স্থানীয় সরকারের উদ্যোগে সম্প্রতি একটি রাস্তা নির্মিত হওয়ায় গ্রামের মানুষ আশার আলো দেখলেও, সেই রাস্তা এখন প্রভাবশালী মহলের দখলে।
স্থানীয় সমাজসেবক গিয়াস উদ্দিনের সভাপতিত্বে আয়োজিত এই মানববন্ধনে বক্তব্য রাখেন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তাফা, ইউপি সদস্য হারুন অর রশিদ, গোলাম রাব্বানীসহ অনেকে।
ভুক্তভোগী গ্রামের বাসিন্দা আনোয়ার হোসেন ও নওসাদুজ্জামান বলেন, "রাস্তাটি দখলের কারণে আমাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে। প্রসব বেদনা ওঠা নারীকে হাসপাতালে নিতে বা হঠাৎ অসুস্থ রোগীকে দ্রুত বাইরে নিতে চরম বেগ পেতে হয়। অ্যাম্বুলেন্স বা অন্য কোনো জরুরি যানবাহন গ্রামে প্রবেশ করতে পারে না। বর্ষাকালে হাঁটু কাদা ভেঙে চলাফেরা করতে হয়। এতে গ্রামের অর্থনীতি পঙ্গু হয়ে পড়েছে।"
তারা আরও জানান, এই গ্রামে প্রায় ২০০ বিঘা জমিতে ধান ও সবজি চাষ হয়। রাস্তা বন্ধ থাকায় মাঠ থেকে ফসল আনা প্রায় অসম্ভব। কৃষিপণ্য পরিবহন খরচ কয়েকগুণ বেড়ে গেছে।
শিক্ষার্থীদের দুর্দশা: 'রাস্তায় কাঁদা, ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত'
শিক্ষার্থী প্রতিনিধি সুমাইয়া আক্তার, আয়েশা সিদ্দিকা এবং জান্নাতুন তাদের দুর্ভোগের কথা তুলে ধরে জানায়, রাস্তা বন্ধ থাকায় স্কুল-কলেজে যাতায়াত করতে ভয়াবহ ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। সুমাইয়া আক্তার বলে, "বর্ষায় রাস্তা কাদা-পানিতে ডুবে যায়। ঠিকমতো স্কুলে যেতে না পারায় আমাদের পড়ালেখার ক্ষতি হচ্ছে। আমরা পিছিয়ে যাচ্ছি, আমাদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে।" গ্রামের অনেক শিক্ষার্থী সময়মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পৌঁছাতে না পারায় ঝরে পড়ার ঝুঁকিতে রয়েছে বলেও জানান তারা।
বিয়ে ভেঙে যাওয়ার মতো সামাজিক বিপর্যয়
গ্রামের কয়েকজন বাসিন্দা অভিযোগ করে জানান, রাস্তার দুরবস্থা এবং চলাচলের পথ বন্ধ থাকায় সম্প্রতি গ্রামে কয়েকটি বিয়ের আলোচনা ভেস্তে গেছে। একজন ভুক্তভোগী বলেন, "রাস্তা নেই বলে বিয়ের বরযাত্রী আসতে রাজি হয়নি। শেষ পর্যন্ত পাকা রাস্তা থেকে অনেক দূর হেঁটে আসতে হয় বলে বিয়ের দিন বরপক্ষ মাঝপথ থেকে ফেরত যাওয়ার মতো দুঃখজনক ঘটনাও ঘটেছে, যা আমাদের পুরো গ্রামের জন্য চরম অপমান।"
দখলদারদের দাপট: 'সরকারি রাস্তার জমিতে পিলার বসিয়ে ঘেরাও'
বক্তারা অভিযোগ করেন, সরকারিভাবে নির্মিত রাস্তাটিকে টার্গেট করে কতিপয় প্রভাবশালী ব্যক্তি সেখানে অবৈধভাবে স্থায়ী স্থাপনা নির্মাণের জন্য পিলার স্থাপন করেছে এবং মাটি ফেলে রাস্তাটিকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। তারা আরও অভিযোগ করেন, যখনই গ্রামবাসী সম্মিলিতভাবে এর প্রতিবাদ জানাতে যায়, তখনই দখলদার চক্রের কাছ থেকে নানা ধরনের হুমকি ও ভয়ভীতি আসে। সর্বশেষ, ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর নামে মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে, যা গ্রামবাসীর ওপর মানসিক ও অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি করেছে।
ভালাইন ইউপি চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তাফা তার বক্তব্যে স্বীকার করেন, "এলাকায় রাস্তা দখলের বিষয়টি বহু পুরনো। গ্রামের মানুষ দীর্ঘদিন ধরে জিম্মি হয়ে আছে। আমরা স্থানীয়ভাবে একাধিকবার বিষয়টি মীমাংসার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছি। যেহেতু এটি সরকারি রাস্তা, আমরা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিতভাবে জানিয়েছি। কিন্তু প্রভাবশালী মহলের কারণে প্রশাসনিক পদক্ষেপ নিতে দেরি হচ্ছে।"
দাবি: দ্রুত উচ্ছেদ অভিযান ও মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার
মানববন্ধনে অংশগ্রহণকারী শতাধিক গ্রামবাসী স্লোগান দিয়ে অবিলম্বে সরকারি রাস্তাটি দখলমুক্ত করার জোর দাবি জানান। তারা প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানান, অবিলম্বে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে সকলের চলাচলের জন্য রাস্তাটি উন্মুক্ত করে দেওয়া হোক। একইসঙ্গে মিথ্যা মামলাগুলো প্রত্যাহার করে দখলদারদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান তারা।
চকশ্রীকৃষ্ণ গ্রামের সচেতন নাগরিক সমাজ হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, তাদের দাবি মানা না হলে রাস্তা দখলমুক্ত না হওয়া পর্যন্ত তারা বৃহত্তর আন্দোলন চালিয়ে যাবেন এবং প্রয়োজনে কঠোর কর্মসূচি দেবেন।
Comments