কাজিপুর যমুনা-ইছামতির চরে লালশাকের লাল চাদর কৃষকদের পরিশ্রম, স্বপ্ন আর আশা
দূর থেকে তাকালে মনে হবে, সিরাজগঞ্জের কাজিপুর উপজেলার যমুনা আর ইছামতি নদীর চরজুড়ে যেন কেউ বিছিয়ে দিয়েছে লাল রঙের বিশাল এক চাদর। সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে সেই লাল রঙ আরও বেশি উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। আর এই লাল সৌন্দর্যের নাম লালশাক। শীতের আগমনে আগাম ফসল হিসেবে চরাঞ্চলের কৃষকরা এই শাক চাষ করেছেন, যার রঙে রঙিন হয়ে উঠছে চরের প্রকৃতি।
চরের মাটি উর্বর কিন্তু জীবন সহজ নয়। নদীর খামখেয়ালি ভাঙন, বন্যা, অনির্দেশ্য আবহাওয়া সবসময় তাদের সঙ্গী। তবুও প্রতিবারের মতো এবারও কৃষকেরা ভরসা রেখেছেন তাদের হাতের পরিশ্রমে, চরাঞ্চলের মাটিতে, আর প্রাকৃতিক ভাগ্যের ওপর।
সরেজমিনে যমুনা-ইছামতি নদীর চরে গেলে চোখে পড়ে জমিনজুড়ে ব্যস্ত কৃষক। কেউ আগাছা পরিষ্কার করছেন, কেউ জমিতে দিচ্ছেন সেচ। অনেকে আবার হাতে স্প্রে মেশিন নিয়ে ছিটাচ্ছেন বালাইনাশক, যেন আগাম সবজির মৌসুমে কোনো ব্যাঘাত না ঘটে।
লালশাকের পাশাপাশি চরজুড়ে সবুজ আর নানান রঙের সমাহার তৈরি করেছে ধনেপাতা, লাউ, মুলা, পুঁইশাক, ফুলকপি, বাঁধাকপি, শিম, টমেটো, পালংশাক ও ডাটা। শীতের আগে আগাম বাজার ধরতে এই সবজির চাষই কৃষকদের প্রধান ভরসা। যমুনার চরে ব্যস্ততার দৃশ্যটি যেন এক প্রাণবন্ত কৃষি উৎসব।
নতুন মাইজবাড়ী চরের কৃষক রফিকুল ইসলাম প্রতিদিন সকাল থেকে মাঠে কাজ করেন। তাঁর ২৬ শতক জমি এখন রঙিন সবজি ক্ষেত। তিনি বলেন, ‘লালশাক, মুলা, পালংশাক আর ধনেপাতা সবই করেছি। মুলা আর পালংশাক বিক্রি শুরু করেছি। লালশাক একটু বড় হলেই বাজারে দিতে পারবো। আশা করছি এবার আগাম সবজিতে ভালো লাভ হবে।’ তার চোখে আশার ঝিলিক যেন লালশাকের রঙেই সেই আশা ফুটে উঠেছে।
মল্লিকা পাড়ার কৃষক আব্দুর রহমানও একই স্বপ্ন দেখছেন। ‘১২ শতক জমিতে লালশাক, মুলাশাক, পালংশাক করেছি সবই ভালো হচ্ছে কিছুদিন গেলেই লালশাক বাজারজাত করতে পারবো। প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে লাভ হবেই’ এমনটাই নিশ্চিত কণ্ঠে বললেন তিনি।
চরের কৃষকদের জীবন যেমন কঠিন, তেমনি জেদিও। বছরে দু’চারবার নদীর ভাঙন তাদের জমি কেড়ে নেয়, আবার সেই নদীই চর উন্মুক্ত করে দেয় নতুন চাষের সম্ভাবনা। এই চক্রেই তারা টিকে থাকে।
কাজিপুর উপজেলা কৃষি অফিসার কৃষিবিদ শরিফুল ইসলাম বলেন, ‘যমুনা চরে কৃষকরা প্রতিবছরের মতো এবারও আগাম সবজির চাষ করছেন। কিছু সবজি ইতোমধ্যে বাজারে গেছে। লালশাক দ্রুতই বিক্রির উপযোগী হবে। ফলন ভালো হবে বলে আশা করছি।’
তিনি আরও জানান, ‘চরাঞ্চলের কৃষকদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ, পরামর্শ, বীজ ও প্রযুক্তিগত সহায়তা দিয়ে সহযোগিতা করা হচ্ছে। এই সহায়তা অনেকটাই সাহস যোগায় চরের মানুষকে।’
চরের লালশাক শুধু কৃষিপণ্য নয় এটি চরবাসীর স্বপ্ন, টিকে থাকার সংগ্রাম আর ভবিষ্যতের আশার প্রতীক। শীত আসতে না আসতেই বাজারে আগাম সবজি তুলতে পারলে তাদের সংসারে আসে স্বস্তি, শিশুদের মুখে হাসি, আর পরিবারের প্রয়োজন মেটানোর সুযোগ।
কখনো কখনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ, কখনো নদীর আচমকা ভাঙন চরের মানুষকে বারবার শূন্য করলেও তারা থামেন না। আবারও চাষ করেন, আবারও নতুন ফসলের স্বপ্ন দেখেন। যমুনা-ইছামতির চরে এই লালশাক তাই শুধু একটি ফসল নয় এটি কৃষকের জীবনযুদ্ধের রঙিন প্রতিচ্ছবি।
যমুনার চরের লাল চাদরে ঢাকা জমি আজ রঙিন স্বপ্নের মাঠ যেখানে প্রতিটি শাকের পাতায় লুকিয়ে আছে কৃষকদের আশা, পরিশ্রম আর অদম্য জীবনীশক্তি।




Comments