দেশের রাবার শিল্প ধাপে ধাপে সফলতার সাথে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। দেশে উৎপাদিত রাবার দেশের চাহিদা পূরণ করে বিদেশে রপ্তানি করা হচ্ছে। যা দেশের জাতীয় অর্থনীতিতে ইতোমধ্যে বিশেষ অবদান রাখতেছে।
১৯৫৪ সালের দিকে বাংলাদেশে রাবারের বাণিজ্যিক চাষে সম্ভাবনা যাচাই করার জন্য বনবিভাগ, জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার বিশেষজ্ঞ মি. ইউলিয়াম লয়েডকে দায়িত্ব দিলে তিনি তার সমীক্ষায় এ দেশের জলবায়ু ও পাহাড়ি এলাকার মাটি বাণিজ্যিক রাবার চাষের উপযোগী বলে অনুকূলে রিপোর্ট দেন। তার সুপারিশের ভিত্তিতে বন বিভাগ ১৯৬০ সালে ৭১০ একরের একটি পাইলট প্রকল্পের মাধ্যমে কক্সবাজারের রামু আর চট্টগ্রামের রাউজানে যথাক্রমে ৩০ এবং ১০ একর বাগান সৃজনের মাধ্যমে দেশের বাণিজ্যিক রাবার চাষ শুরু করেন। পরবর্তীতে দেশে ১৮টি রাবার বাগান গড়ে উঠে। এসব রাবার বাগানে বাণিজ্যিকভাবে রাবার চাষ হচ্ছে।
দেশের প্রথম রাবার বাগান কক্সবাজার জেলার রামুতে অবস্থিত। বন, পরিবেশ ও জলবায়ু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে বাংলাদেশ বনশিল্প উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএফআইডিসি) এর মালিকানাধীন দেশে রাবার বাগান রয়েছে ১৮টি। রামুর রাবার বাগানটি আয়তনের দিক দিয়ে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম। দেশের সবচেয়ে বড় রাবার বাগানটি চট্টগ্রাম জেলার ফটিকছড়িতে অবস্থিত। যেটি এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বৃহৎ।
কক্সবাজারের রামুর জোয়ারিয়ানালা এলাকায় দেশে কাঁচা রাবারে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের জন্য বাংলাদেশ বনশিল্প উন্নয়ন করপোরেশনের সহায়তায় ১৯৬০-৬১ সালে ৩০ একর অনাবাদি জমি গবেষণার মাধ্যমে মালয়েশিয়া থেকে বীজ এনে সরকারিভাবে রামুতে প্রথম মাতৃ রাবার বাগানে রাবার চাষাবাদ শুরু করা হয়। বর্তমানে এর আয়তন ২ হাজার ৬৮২ একর। এ বাগানের চারপাশে ছোট বড় অসংখ্য পাহাড়, টিলা ও বিস্তৃত সমতল পাহাড়ের মাঝে ২,৬৮২ একর জায়গা জুড়ে বিস্তৃত ১ লাখ ৮০ হাজার ৬১৬টি গাছ রয়েছে।
শুরুর দিকে বাগানে রাবার উৎপাদনশীল গাছের সংখ্যা প্রায় ৫৮,০০০টি থাকলেও বর্তমানে প্রায় ১,৪০,০০০ টি উৎপাদনশীল গাছ রয়েছে। যা থেকে বাগানের ১ হাজার ১৩০ একর এলাকা থেকে লিকুইড বা কষ সংগ্রহ করা হয়।
রামু রাবারবাগানের ব্যবস্থাপক শফিকুল ইসলাম জানান, মহাসড়কের দুই পাশ ঘেঁষে চা-বাগান এলাকা থেকে উত্তরে জোয়ারিয়ানালার মালাপাড়া, পূর্বে জুমছড়ি, গর্জনিয়া, দক্ষিণে লট উখিয়ার ঘোনা পর্যন্ত বর্তমানে বাগানের অবস্থান। বাগানে মূলত সারা বছরই রাবার উৎপাদন হয়। তবে অক্টোবর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত চার মাস পর্যন্ত রাবার উৎপাদনের ভরা মৌসুম।
ভরা মৌসুমে প্রতিদিন রাবারবাগান থেকে প্রায় ৫ হাজার কেজি কষ আহরণ করা হয়। যা মৌসুমে প্রতিদিন এ বাগান থেকে ৩০ থেকে ৩৫ মেট্রিক টন শুকনো রাবার উৎপাদন করা হচ্ছে। শীতের সময়ে আহরণ বেশি হয়। বর্ষায় উৎপাদন কমে আসে।
রাবার বাগানের এসব গাছ থেকে বছরে প্রায় আড়াই লাখ কেজি রাবার উৎপাদিত হয়। এভাবে প্রতি বছরে প্রায় ২২০ টন শুকনা রাবার উৎপাদন করা হচ্ছে। এ উৎপাদিত রাবার বর্তমানে দেশের ৬০ থেকে ৬৫ ভাগ চাহিদা পূরণ করা করছে। যে অর্থ দেশের অর্থনীতিতে বিরাট ভূমিকা পালন করছে।
একটি রাবার গাছ ২৫ বছর পর্যন্ত রাবার কষ উৎপাদন করতে পারে এবং ৩২-৩৩ বছর বয়সে গাছগুলো অর্থনৈতিকভাবে উৎপাদন ক্ষমতা হারায়।
পরিবেশ রক্ষায় এ গাছের অবদান অন্য যেকোন গাছের চেয়ে উল্লেখ করার মতো। বৈশ্বিক উষ্ণতারোধ ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় রাবার গাছ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে যাচ্ছে। এ গাছ অন্য যেকোন গাছের তুলনায় বেশি পরিমাণ অক্সিজেন উৎপাদন এবং কার্বন শোষণ করে।
এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি হেক্টর রাবার বাগান (যেখানে প্রায় ৪১৫টি উৎপাদনশীল রাবার গাছ রয়েছে) বায়ুমণ্ডল থেকে বার্ষিক ৩৩.২৫ টন কর্বন শোষণ করে যা পরিবেশের উষ্ণতা রোধে ও পরিবেশ রক্ষায় অতি পুরুত্বপূর্ণ। সুতরাং রাবার গাছ যেমন দেশের অর্থনীতি বিকাশে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে ঠিক তেমনি পরিবেশ রক্ষায় সমান অবদান রেখে যাচ্ছে। তাই দেশে বিপুল সংখ্যক সরকারি ও বেসরকারিভাবে রাবার বাগান গড়ে তুলে বাণিজ্যিকভাবে রাবার চাষ করা এখন সময়ের দাবি।
তিনি আরো জানান, রাবার চাষের জন্য ভূমি, আবহাওয়া ও বৃষ্টিপাতের বিষয়গুলো বিবেচনায় রাখতে হয়। কেননা জলবায়ু, আবহাওয়া ও মাটির গঠনের উপর রাবার চাষের সফলতা নির্ভরশীল। সমুদ্র পৃষ্ঠ হতে ১০০-২০০ মিটার উচ্চতার ভূমি রাবার চাষের জন্য সর্বাধিক উপযোগী। মাটির গঠন ৩৫ শতাংশ কাদা ও ৩০ শতাংশ বালি অর্থাৎ বেলে দোঁয়াশ মাটি, মাটিতে নাইট্রোজেন, ফসফেট, পটাসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম ও ম্যাংগানিজ ইত্যাদি পদার্থ কম বেশি থাকা প্রয়োজন। তাছাড়া ভূপৃষ্ঠ হতে নিচে অন্তত ১০০ সে.মি. পর্যন্ত পাথর স্তর মুক্ত ও পানির স্তর ১০০-১৫০ সে.মি. থাকার প্রয়োজন হয়। সারা বছরে গড় বৃষ্টিপাত ২০০-২৫০ সে.মি. এবং গড় তাপমাত্রা ২৫-৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস হওয়া বাঞ্ছনীয়। মাটির পি এইচ রেঞ্জ ৪-৫.৫ এর মধ্যে থাকতে হবে। রাবার চাষ এলাকায় পানি জমে থাকতে পারবে না এবং পানি নিষ্কাশনের সুব্যবস্থা থাকতে হবে।রাবার বাগান তৈরির জন্য নির্বাচিত জায়গায় জংগল ও আগাছা খুব ভালোভাবে পরিষ্কার করতে হয়।
বাগান জরিপ ও সীমানা নির্ধারণ ও একর প্রতি চারা রোপণের বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে প্রতি একরে ২২৫টি হারে রাবার চারা রোপণ করা হচ্ছে।
তাছাড়া রাবার চাষের জন্য স্থান নির্বাচনের সময় নিয়ে বর্ণিত বিষয়ে সঠিক বিবেচনা করা অত্যন্ত প্রয়োজন। যেমন: মাটি, টপোগ্রাফি, বৃষ্টিপাত, পানি নিষ্কাশনের সুবিধা ও যাতায়াতের সুবিধা ইত্যাদি।
রামু রাবারবাগান শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি আবছার মিয়া জানান, রাবার বাগানের কষ আহরণে নিয়মিত-অনিয়মিত প্রায় ২২০ জন শ্রমিক নিয়োজিত রয়েছেন। মূলত রাবার উৎপাদনে শ্রমিকেরা প্রত্যক্ষভাবে জড়িত থাকে বিধায় তাদের উৎসাহ উদ্দীপনার দিক বিবেচনা করা উচিত কর্তৃপক্ষের। এতে করে সংশ্লিষ্ট কাজের গতি বাড়বে আর নতুনরাও এ কাজে নিয়োজিত হতে আগ্রহী হবে।
বাগানের মাঠ তত্ত্বাবধায়ক সাইদুল ইসলাম জানান, পাত্রে জমা হওয়া রাবারের কষ সংগ্রহ করে শ্রমিকেরা ভারে করে আবার দূরবর্তী স্থানে গাড়িতে করে কষ নিয়ে যায় কারখানায়। আনার পরে কষগুলো নিদির্ষ্ট পাত্রে ঢালা হয়। এরপর কষের সঙ্গে পানি ও অ্যাসিড মিশিয়ে নির্ধারিত স্টিলের ট্যাং-এ জমা রাখা হয়। সেখানে আলাদা প্লেট বসিয়ে কোয়াগোলাম বা রাবার সিটে পরিণত করা হয়। এরপর রোলার মেশিনের সাহায্যে কষ থেকে পানি বের করে ড্রিপিং শেডে শুকানো হয়। পরে ধুমঘরে তা পোড়ানো হয়। ওই প্রক্রিয়া শেষে রাবার ৫০ কেজি ওজনের বান্ডিল করে বস্তাভর্তি করে গুদামজাত করা হয়। বাগান থেকে কষ এনে শুকনো রাবার সিটে পরিণত করতে সময় লাগে সর্বোচ্চ ৭ দিন।
এভাবে রাবার শিল্প থেকে দেশে উৎপাদিত রাবার দেশের চাহিদা পূরণ করে বিদেশে রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের মাধ্যমে দেশের জাতীয় অর্থনীতিতে বিশেষভাবে অবদান রাখছে।
তাই বাংলাদেশ বন সম্পদ শিল্প উন্নয়ন কর্পোরেশনে রাবার চাষ বা উৎপাদন বাড়াতে সরকারকে আরও কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
বর্তমানে কক্সবাজারের রামুর ঐতিহ্যবাহী রাবার বাগানের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং মনোরম পরিবেশ দর্শনার্থীদের জন্য দেশের একটি অন্যতম পর্যটন স্থান হিসেবে পরিচিত। পাহাড় আর সমতলের অপূর্ব মিলনের দৃশ্য উপভোগ করে মুগ্ধহন ভ্রমন পিপাসুরা। এখানে বাগান র্কতৃপক্ষের একটি দৃষ্টিনন্দন বিশ্রামাগার (রেষ্ট হাউস) রয়েছে। প্রতিদিন দেশ বিদেশের অসংখ্য পর্যটক রাবার বাগান ও রাবারের উৎপাদন প্রক্রিয়া দেখতে বাগানে ঘুরতে আসেন। রামু রাবার বাগানের খোলামেলা পরিবেশ পিকনিক স্পট হিসেবে বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করছে।




Comments