Image description

পাইকগাছায় ভোর মানেই সূর্যোদয়ের আগে বিষাক্ত ধোঁয়ার আগ্রাসন। দূর থেকে কুয়াশা মনে হলেও কাছে গেলেই স্পষ্ট এটি অবৈধ ইটভাটার কালো ধোঁয়া। পরিবেশগত ছাড়পত্র, অগ্নি নিরাপত্তা ও প্রয়োজনীয় আইনি অনুমোদন ছাড়াই বছরের পর বছর ধরে উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ইটভাটা চালু রয়েছে। বসতবাড়ি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ফসলি জমির সন্নিকটে এসব ভাটা পরিচালিত হওয়ায় মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়ছে জনস্বাস্থ্য, কৃষি ও পরিবেশ।

উপজেলার চাঁদখালী, গদাইপুর, রাড়ুলী ও হরিঢালী ইউনিয়নে বর্তমানে অন্তত ১৩টি ইটভাটা সক্রিয় রয়েছে। এর মধ্যে মাত্র একটি ভাটার বৈধ কাগজপত্র রয়েছে বলে জানা গেছে। বাকি ১২টি ভাটা সম্পূর্ণ অবৈধভাবে কৃষিজমির ওপর স্থাপিত। পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ও ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন অনুযায়ী এসব ভাটা পরিচালনা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ হলেও বাস্তবে তার কোনো প্রতিফলন নেই।

স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রশাসনের অজান্তে নয়—বরং প্রশাসনের নীরবতাকেই পুঁজি করে চলছে এই ধোঁয়ার সাম্রাজ্য। দিনের পর দিন অবৈধ কার্যক্রম চললেও কার্যকর অভিযান না হওয়ায় জনমনে ক্ষোভ ও সন্দেহ দানা বাঁধছে। অনেকেই বলছেন, প্রভাবশালী একটি চক্র প্রশাসনের ভেতরে-বাইরে সমঝোতার মাধ্যমে এসব ভাটা টিকিয়ে রেখেছে।

ইটভাটার কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন কৃষকরা। জমির ফসলের পাতায় কালো ছাই জমে ফলন কমে যাচ্ছে। এক কৃষক বলেন, “ধান আর সবজিতে ধোঁয়ার আস্তরণ পড়ে। আগের মতো ফলন হয় না। জমি ধীরে ধীরে বিষাক্ত হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু ক্ষতির দায় কেউ নেয় না।”

শুধু পরিবেশ নয়, সড়ক যোগাযোগেও মারাত্মক প্রভাব ফেলছে এসব ভাটা। শুকনো মৌসুমে ভাটার মাটি পড়ে সড়ক ধুলোময় হয়ে ওঠে, আর বর্ষায় সেই মাটি কাদায় পরিণত হয়ে যান চলাচলের জন্য চরম ঝুঁকি তৈরি করে। প্রতিবাদ করলেই ভাটামালিকদের পক্ষ থেকে ভয়ভীতি দেখানোর অভিযোগও রয়েছে।

অগ্নি নিরাপত্তার দিক থেকেও ভাটাগুলো চরম ঝুঁকিপূর্ণ। অধিকাংশ ভাটায় নেই ফায়ার এক্সটিংগুইশার, প্রশিক্ষিত কর্মী বা জরুরি ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা। কাঠ ও নিম্নমানের জ্বালানি ব্যবহারের ফলে যে কোনো সময় বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ড ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা স্থানীয়দের।

শ্রমিকদের অবস্থাও মানবেতর। সুরক্ষা সরঞ্জাম ছাড়াই ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন তারা। নেই স্বাস্থ্য পরীক্ষার ব্যবস্থা, নেই চিকিৎসা সহায়তা। নারী ও কিশোর শ্রম ব্যবহারের অভিযোগও উঠেছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক শ্রমিক বলেন, “কাজ না করলে পরিবার চলবে না। অসুস্থ হলে নিজের খরচেই চিকিৎসা করতে হয়।”

গত বছর তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহেরা নাজনীন অবৈধ ইটভাটাগুলো বন্ধে সাত দিনের আল্টিমেটাম দিয়েছিলেন। সভায় প্রশাসনের কর্মকর্তা, ভাটামালিক ও রাজনৈতিক নেতারা উপস্থিত থাকলেও বাস্তবে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। সময়সীমা পার হওয়ার পরও ভাটাগুলো আরও দাপটের সঙ্গে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।

বর্তমান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ওয়াসিউজ্জামান চৌধুরী জানান, তিনি সদ্য যোগদান করেছেন এবং শিগগিরই অভিযান পরিচালনার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, “অবৈধভাবে কোনো ইটভাটা চলতে দেওয়া হবে না। বৈধতা না থাকলে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হবে।”

খুলনা পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. আসিফুর রহমান জানান, নিরাপত্তা নিশ্চিত করে যৌথ অভিযান পরিচালনার পরিকল্পনা রয়েছে।

পাইকগাছার আকাশে প্রতিদিনই ধোঁয়া উঠছে। এখন প্রশ্ন একটাই—এই ধোঁয়ার বিরুদ্ধে প্রশাসনের অভিযান কি সত্যিই মাঠে নামবে, নাকি আগের মতোই সব আশ্বাস ধোঁয়ার সঙ্গে মিলিয়ে যাবে? স্থানীয়দের দাবি স্পষ্ট—এবার যেন আইন কেবল কাগজে নয়, বাস্তবেও কার্যকর হয়।