শিক্ষার্থী থেকে স্কুল সভাপতি, ক্লাসে ঢুকে অর্ধশত শিক্ষার্থীকে পেটালেন বৈষম্যবিরোধী নেতা

এখনও নিজে শিক্ষার্থী, তবু একটি উচ্চ বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি হয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের রংপুর মহানগর কমিটির (বিলুপ্ত) সাবেক আহ্বায়ক ইমতিয়াজ আহমদ ইমতি। এবার তার বিরুদ্ধে বেত দিয়ে অর্ধশত শিক্ষার্থীকে পিটিয়ে আহত করার অভিযোগ উঠেছে।
ঘটনাটি ঘটেছে গত ৪ সেপ্টেম্বর রংপুর নগরীর হারাটি উচ্চ বিদ্যালয়ে। তবে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন এই নেতা। কিন্তু ১৮ দিন পর বিষয়টি জানাজানি হলে তোলপাড় শুরু হয়।
বিষয়টি নিশ্চিত করে মেট্রোপলিটন পুলিশের পরশুরাম থানার ওসি মাইদুল ইসলাম বলেন, ইমতিয়াজ আহমদ স্কুল ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি হিসেবে স্কুলে গিয়ে শিক্ষার্থীদের শাসন করেছিলেন। এ ঘটনায় একজন অভিভাবক অনলাইনে জিডি করেন। এরপর ওই বিদ্যালয়ে পুলিশ পাঠানো হয়েছিল।
ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী ও বেশ কয়েকজন অভিভাবক জানিয়েছেন, ইমতিয়াজ ঢাকায় একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। ৫ আগস্টের পর হঠাৎ বিশাল নেতা বনে যান। এরপর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের রংপুর মহানগর আহ্বায়ক হওয়ার পর তার ক্ষমতার দাপটের কাছে অসহায় ছিলেন এলাকাবাসী। এই প্রভাব খাটিয়ে সব নিয়ম উপেক্ষা করে ছাত্র হয়েও হারাটি উচ্চ বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতির পদটি বাগিয়ে সেখানে ক্ষমতার অপব্যবহার করে আসছিলেন।
গত ৪ সেপ্টেম্বর ইমতিয়াজ বিদ্যালয়ে গিয়ে অর্ধবার্ষিক পরীক্ষায় অনেক শিক্ষার্থী ফেল করেছে শুনে তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠেন। এরপর একটি বেত নিয়ে বিদ্যালয়ের তিন শ্রেণিকক্ষে প্রবেশ করে অর্ধশত শিক্ষার্থীকে বেধড়ক পেটান। এতে বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী আহত হয়।
শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেন, গত ৪ সেপ্টেম্বর (বৃহস্পতিবার) বিদ্যালয়ের টিফিন শেষে ক্লাস চলছিল। এমন সময় ইমতিয়াজ মোটরসাইকেলে করে বিদ্যালয়ে গিয়ে অষ্টম, নবম ও দশম শ্রেণির কক্ষে যান। সেখানে উপস্থিতি ছাত্রছাত্রীদের কাছে অর্ধবার্ষিক পরীক্ষার ফল জানতে চান। যেসব শিক্ষার্থী ‘অকৃতকার্য’ হয়েছে, তাদের একে একে ডেকে বেত দিয়ে বেধড়ক পিটিয়ে আহত করেন। ওই সময় শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকরা উপস্থিত থাকলেও কেউ তার ভয়ে প্রতিবাদ করার সাহস পাননি।
এ বিষয়ে এক শিক্ষক নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, ‘ইমতিয়াজ বড় নেতা ও ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি- কখন কার চাকরি খেয়ে ফেলেন; সেই ভয়ে আমরা প্রতিবাদ করার সাহস পাই নাই।’
১০ম শ্রেণির শিক্ষার্থী রিফাত ইসলাম ওই দিনের ঘটনা বর্ণনা দিয়ে বলেন, ‘টিফিনের পর ক্লাসে স্যারসহ আমরা সবাই ছিলাম। ক্লাস চলাকালে ইমতিয়াজ সাহেব একটা বেত নিয়ে ঢুকে বলতেছে, কে কে ফেল করছো, দাঁড়াও। আমরা দাঁড়াইলাম। পরে একেকজন করে ডাকছে, আর বেত দিয়ে পিটিয়েছে। মেয়েদেরও তিনি পিটিয়েছেন। বেত দিয়ে পেটানোতে শরীরে বিভিন্ন অংশ লাল হয়ে গেছে। শুধু তাই নয়, নবম শ্রেণির ক্লাসে ঢুকে পেটাতে পেটাতে বেত ভেঙে ফেলেছে।’
১০ম শ্রেণির শিক্ষার্থী সীমান্ত শীল ও শিমুল শর্মা বলেন, ‘বই দেওয়া হয়েছিল গত এপ্রিলে। ক্লাস হয়েছিল অল্প দিন। আবার প্রশ্ন ছিল নতুন। এ কারণে অর্ধবার্ষিক পরীক্ষা বেশি কঠিন ছিল। বই দেরিতে দেওয়া ও পাঠ্যক্রম নতুন সৃজনশীল হওয়ায় ক্লাসের ৩ ভাগের আড়াই ভাগ ফেল করেছিল।’
ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী অভিযোগ করেন, সভাপতি এসে এসব কিছু শোনেননি। তিনি শিক্ষার্থীদের গরু পেটানোর মতো করে পিটিয়ে আহত করেন।
ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের অভিযোগ, ওই দিন পঞ্চাশেরও বেশি শিক্ষার্থীকে পেটানো হয়। এর মধ্যে ১০ থেকে ১৫ শিক্ষার্থী অসুস্থ হয়ে পড়ে।
জ্বর ও ব্যথা না কমায় শিক্ষার্থী আইরিন আক্তারকে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ২ দিন ভর্তি রাখতে হয় বলে জানান তার মা দুলালী বেগম।
শিক্ষার্থীদের মারধরের বিষয়ে জানতে চাইলে স্কুল ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি ইমতিয়াজ আহমদ ইমতি বলেন, ‘ওই কাজ করছি যাতে শিক্ষার্থীরা ভালো ফল করে। ওদের ক্লাসের যেগুলো সমস্যা ছিল, সমাধান করেছি। সে জন্য একটু রাগারাগি করছি, শাসন করছি এই আর কী। কিন্তু এটা নিয়া ৯৫ শতাংশ শিক্ষার্থীর কোনও কমপ্লেন (অভিযোগ) নেই।’
কিন্তু শাসনের নামে এভাবে শিক্ষার্থীদের শারীরিক নিযাতন করতে পারেন কি না জানতে চাইলে বলেন, ‘আমি নিজেও এই এলাকার বড় ভাই। একটু শাসন করছি। এটা নিয়ে বাড়াবাড়ি হচ্ছিল। এলাকার কিছু ব্যক্তি ঘটনাকে অতিরঞ্জিত করার চেষ্টা করেছিল। তবে এটা মীমাংসা হয়ে গেছে।’
হারাটি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আতাউর রহমান বলেন, ‘শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের সম্মতিতে তিনি এ বিষয়টি মীমাংসা করে দিয়েছেন।’
কী ঘটনা ঘটেছিল- জানতে চাইলে আতাউর রহমান বলেন, ‘ওটা কিছু না। উনি এসে বাচ্চাদের বলে ভালো পড়াশোনা করো। ভালো রেজাল্ট করো। এই আর কী।’
শিক্ষার্থীদের মারধরের বিষয়ে জানতে চাইলে আতাউর রহমান বলেন, ‘ওটা তো উনি করতে পারেন না। তবে আমি অভিভাবক নিয়ে মীমাংসা করে দিছি। শিক্ষার্থীরাও মেনে নিয়েছে।’
এ ব্যাপারে রংপুর সদর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আবদুল হাই বলেন, ‘শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের শারীরিক নির্যাতনের কোনও সুযোগ নেই। এটি নিষিদ্ধ। হারাটি উচ্চ বিদ্যালয়ে এ ঘটনা ঘটে থাকলে প্রধান শিক্ষক জানাননি। খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নিচ্ছি।’
বিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, গত ফেব্রুয়ারিতে হারাটি উচ্চ বিদ্যালয়ের অস্থায়ী (অ্যাডহক) কমিটির আহ্বায়ক হন একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ইমতিয়াজ আহমদ ইমতি। তখন তিনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের রংপুর মহানগর কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন। ওই সময় প্রশাসনকে ম্যানেজ করে শিক্ষার্থী থাকা সত্ত্বেও সব নিয়ম-কানুনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে তিনি স্কুল ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি হন।
এ বিষয়ে হারাটি এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা ও মহানগর বিএনপির ৪নং ওয়ার্ডের যুগ্ম সম্পাদক রফিকুল বলেন, এটা কোনোভাবেই ‘শাসন’ নয়, শিক্ষার্থী নির্যাতন। একই সঙ্গে ফৌজদারি অপরাধ। প্রধান শিক্ষকের উচিত ছিল বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া। কিন্তু তিনি তা না করে ঘটনাটি ধামাচাপা দিয়েছেন। এ বিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি করেন তিনি।
Comments