Image description

ফরিদপুরসহ দক্ষিণাঞ্চলের ৪২৭ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের মহাসড়কগুলোতে গত এক বছরে (২০২৪ সালের ১ অক্টোবর থেকে ২০২৫ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত) ৪০৬টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় ২৯০ জন নিহত এবং ৭৮৪ জন আহত হয়েছেন, মোট হতাহতের সংখ্যা প্রায় ১০৭৪ জন। মাদারীপুর রিজিয়ন (হাইওয়ে পুলিশ) কার্যালয় সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।

মাদারীপুর রিজিয়নের আওতাধীন ৪২৭ কিলোমিটার মহাসড়কে ৫টি থানা, ১টি পুলিশ ফাঁড়ি, ৩টি ক্যাম্প এবং ৩৮টি টহল টিম রয়েছে, যেখানে মোট লোকবল ২৫৮ জন। মহাসড়ক ছাড়াও বিভিন্ন আঞ্চলিক সড়ক, উপজেলা ও গ্রামীণ রাস্তায় গত এক বছরে কমপক্ষে কয়েকশ সড়ক দুর্ঘটনায় অন্তত শতাধিক ব্যক্তি প্রাণ হারিয়েছেন।

গত এক বছরে ৪০৬টি দুর্ঘটনার মধ্যে লোকাল বাস, ট্রাক, নসিমন, পিকআপ ও মোটরসাইকেলের সংখ্যা বেশি। এসব দুর্ঘটনায় ১৮ থেকে ৪৫ বছর বয়সী মানুষের সংখ্যা বেশি, বিশেষ করে বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালক-আরোহী ও লোকাল বাসের যাত্রীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য।

দুর্ঘটনার কারণসমূহ:

হাইওয়ে পুলিশ, চালক ও যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ফরিদপুর-মাদারীপুর অঞ্চলের আওতাধীন ২২টির অধিক মহাসড়কে নছিমন, করিমন, ভটভটি, মাহিন্দ্র, ব্যাটারিচালিত রিকশা, ইজিবাইক ও ভাড়ায়চালিত মোটরসাইকেল চলাচল বন্ধের নিষেধাজ্ঞা থাকলেও এসব অবৈধ যান অবাধে চলাচল করে। পদ্মা সেতু চালুর পর ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে দক্ষিণবঙ্গে আঞ্চলিক ও দূরপাল্লার পরিবহন চলাচল বৃদ্ধি পেয়েছে, যার ফলে মহাসড়কে অবৈধ যান চলাচলের কারণে প্রতিনিয়ত নানা দুর্ঘটনা ঘটছে। এছাড়াও ত্রুটিপূর্ণ সড়ক ব্যবস্থার কারণে দুর্ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

মহাসড়কগুলোতে বাঁক থাকার কারণে অনেক চালক দুর্ঘটনা ঘটিয়ে থাকেন। রাস্তার পাশে অবৈধ স্থাপনা, হাট-বাজার স্থাপন এবং ওভারব্রিজ না থাকার কারণেও দুর্ঘটনা ঘটে। এছাড়া অদক্ষ চালক, ওভারটেকিং, বেপরোয়া গতি, চলন্ত গাড়িতে চালকের মোবাইলে কথা বলা, চোখে ঘুম নিয়ে গাড়ি চালানোর কারণেও দুর্ঘটনা ঘটে থাকে।

ফরিদপুর গোল্ডেন লাইন পরিবহনের চালক মো. লিয়াকত হোসেন বলেন, রাস্তা খারাপের কারণে দুর্ঘটনা ঘটে। একটানা দীর্ঘক্ষণ গাড়ি চালানোর কারণেও দুর্ঘটনা হয়। অবৈধ যানবাহনগুলো রাস্তায় এলোমেলো চলাচল করে, তাদের বেপরোয়া চলাচলেও দুর্ঘটনা ঘটে। রাস্তার ওপর হাটবাজার, রাস্তায় গাড়ি আছে কি-না, তা না দেখেই পারাপার বা পাল্লাপাল্লির কারণেও দুর্ঘটনা হয়।

ফরিদপুর শহরের বাসিন্দা ও মুক্ত সমাজের সভাপতি পারভেজ হাসান রাজিব বলেন, বেপরোয়া গতিতে যানবাহন চালানো, অদক্ষ চালক, ভাঙা রাস্তা, উঠতি বয়সী তরুণদের বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানোর কারণে দুর্ঘটনাগুলো বেশি ঘটে। বিশেষ করে গোল্ডেন লাইন পরিবহনগুলোতে বেশি দুর্ঘটনা ঘটে।

প্রতিকার ও সচেতনতা:

ফরিদপুর জেলা বাস মালিক গ্রুপের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মো. আনিসুর রহমান বলেন, ভাঙাচোরা রাস্তা, পরিবহনগুলোর যান্ত্রিক ত্রুটি, অদক্ষ চালক ও পথচারীদের এলোমেলো চলাচলের কারণে মূলত সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে থাকে।

ভাঙ্গা হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রোকিবুজ্জামান বলেন, বেপরোয়া মোটরসাইকেলের চালক ও দ্রুতগামী পরিবহনগুলোতে দুর্ঘটনা বেশি ঘটে।

হাইওয়ে পুলিশের মাদারীপুর রিজিয়নের ফরিদপুর কার্যালয়ের পুলিশ সুপার মো. রহমতুল্লাহ বলেন, গতবারের তুলনায় এ বছর সড়ক দুর্ঘটনার পরিমাণ ও হতাহতের সংখ্যা তুলনামূলক কম। মহাসড়কগুলোতে চলাচলকারী বিভিন্ন ধরনের যানবাহনগুলোকে হাইওয়ে পুলিশ নজরদারিতে রাখে এবং বেপরোয়া চলাচলকারী যানবাহনগুলোকে মামলা ও জরিমানা করা হয়। তিনি আরও বলেন, মহাসড়কগুলোতে বিভিন্ন ধরনের অবৈধ যানবাহন চলাচল করে এবং ওভারটেকিং ও বেপরোয়া গতির কারণে দুর্ঘটনা ঘটে। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে পুলিশ, পথচারী ও চালকদের সচেতনতার বিকল্প নেই।

বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) ফরিদপুরের সহকারী পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ নাছির উদ্দীন বলেন, বিআরটিএ থেকে চালকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় এবং সড়ক দুর্ঘটনা রোধে চালক ও সাধারণ মানুষের মাঝে জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। ফরিদপুরে চলতি অর্থবছরে সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতদের মাঝে দুই কোটি পঁচিশ লাখ টাকা আর্থিক সাহায্য করা হয়েছে।

নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের (নিসআ) ফরিদপুরের সভাপতি আবরাব নাদিম ইতু বলেন, চালকরা অনেক সময় ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত অবস্থায় গাড়ি চালাতে বাধ্য হন, ফলে তারা নিজের অজান্তেই নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটিয়ে ফেলেন।

ফরিদপুর জর্জ কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট সেলিমুজ্জামান রুকু বলেন, সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সবার আগে চালকদের সচেতন হতে হবে। অসুস্থ বা ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত অবস্থায় গাড়ি চালানো যাবে না। ওভারটেকিং প্রবণতা কমাতে হবে। সড়কে বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালকসহ যানবাহন চালকদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে।

ফরিদপুর নাগরিক মঞ্চের সাধারণ সম্পাদক প্রবীর কান্তি পান্না বালা বলেন, যানবাহন চালকদের অসাবধানতা ও লাইসেন্সবিহীন অদক্ষ চালক, ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, রাস্তার স্বল্পতা-অপ্রশস্ততা, পাল্লা দিয়ে গাড়ি চালানো ও ওভারটেকিং, ট্র্যাফিক আইন সম্পর্কে অজ্ঞতা ও ট্র্যাফিক আইন ভঙ্গ করা, পথচারীদের মধ্যে অসচেতনতা, ফুটপাত হকারদের দখলে থাকার কারণে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনা ঘটছে। এছাড়াও বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও তদন্তের পর বাস্তবায়নে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয় না, যার কারণে দুর্ঘটনা রোধে কোনো ফলাফলও পাওয়া যায় না।