
সিরাজগঞ্জের কাজিপুর উপজেলার নাটুয়ারপাড়া ইউনিয়নের পানাগাড়ী কমিউনিটি ক্লিনিকে দিনের বেশিরভাগ সময় দরজা বন্ধ থাকে। সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার কথা থাকলেও, বাস্তবে সেই নিয়মের কোনো চিহ্ন নেই এখানে।
১৯ অক্টোবর (রবিবার) সকাল ৯টা ৩০ মিনিটে গিয়ে দেখা যায়, ক্লিনিকের দরজা তখনও তালাবদ্ধ। স্থানীয়রা জানালেন, দায়িত্বপ্রাপ্ত স্বাস্থ্যকর্মী সজ্জিতা প্রায় প্রতিদিনই সকাল ১০টা থেকে ১১টার মধ্যে আসেন এবং দুপুর ১টার দিকেই ক্লিনিক বন্ধ করে চলে যান।
একজন স্থানীয় প্রবীণ নাগরিক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “আমরা অনেক সময় সকালে ওষুধ নিতে যাই, কিন্তু দেখি দরজা বন্ধ। আবার দুপুরে গেলে বলে—আজ আর ওষুধ নাই, কাল আসেন। গ্রামের গরিব মানুষ তো বারবার যেতে পারে না।”
সরকারের নীতিমালা অনুযায়ী, প্রত্যেকটি কমিউনিটি ক্লিনিক সপ্তাহে ছয় দিন সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত খোলা থাকার কথা। সেখানে একজন কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার (CHCP) দায়িত্ব পালন করবেন। কিন্তু পানাগাড়ী ক্লিনিকে সেই নিয়ম মানা হচ্ছে না বলেই অভিযোগ উঠেছে স্থানীয়দের কাছ থেকে।
ক্লিনিকের আশপাশের লোকজন জানান, সাইনবোর্ড অনেক সময় খুলে ফেলা হয়, যেন ছবি তুলে কেউ প্রমাণ রাখতে না পারে। একজন স্থানীয় যুবক বলেন, “সাইনবোর্ড নামিয়ে রাখে, কেউ ছবি তুললে সমস্যা হয়। সাংবাদিকরা গেলেও আগে থেকে খবর পায়, তাই তখন ঠিকঠাক দেখানোর চেষ্টা করে।”
পানাগাড়ী কমিউনিটি ক্লিনিকের দায়িত্বপ্রাপ্ত স্বাস্থ্যকর্মী সজ্জিতার বিরুদ্ধে অভিযোগ নতুন নয়। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, এর আগেও একাধিকবার তার দায়িত্বহীন আচরণের ব্যাপারে লিখিত অভিযোগ করা হয়েছে। এমনকি উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মো. রাসেল নিজেও একদিন বিকেল ১টা ৩৫ মিনিটে পরিদর্শনে গিয়ে ক্লিনিকটি তালাবদ্ধ অবস্থায় পান।
এ বিষয়ে ডা. রাসেল বলেন,“আমরা অভিযোগ পেয়েছি এবং কয়েকবার মৌখিকভাবে সতর্ক করেছি। কিন্তু সমস্যা পুরোপুরি সমাধান হয়নি। শিগগিরই প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
পানাগাড়ী ইউনিয়নের মানুষরা এখন এই ক্লিনিকের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলছেন। অনেকেই বাধ্য হয়ে কাজিপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স কিংবা দূরের বেসরকারি ফার্মেসির আশ্রয় নিচ্ছেন, যা সময় ও অর্থ—দুটোরই অপচয় ঘটাচ্ছে।
স্থানীয় গৃহবধূ মিনা বেগম বলেন, “আমার ছেলের জ্বর হলে এখানে ওষুধ পাই না। সকালেও তালা, দুপুরে গেলেও বলে সময় শেষ। এখন তো আর বিশ্বাসই হয় না।”
কমিউনিটি ক্লিনিক প্রকল্পের মূল লক্ষ্য ছিল, গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর দোরগোড়ায় বিনামূল্যে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়া। কিন্তু পানাগাড়ী ক্লিনিকের এই অনিয়ম সেই উদ্দেশ্যকেই প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
স্থানীয় সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা বলছেন,“এভাবে যদি দায়িত্বপ্রাপ্তরা নিয়ম মানে না, তাহলে সরকার যত উদ্যোগই নিক না কেন, জনগণ তার সুফল পাবে না। প্রশাসনকে কঠোর হতে হবে।”
বিগত কয়েক বছরে বিভিন্ন গণমাধ্যমে এই বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হলেও বাস্তব চিত্রে কোনো পরিবর্তন আসেনি। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিয়মিত তদারকি ও কঠোর প্রশাসনিক ব্যবস্থা ছাড়া এই অনিয়ম বন্ধ হবে না বলে মনে করছেন স্থানীয়রা।
পানাগাড়ী গ্রামের প্রবীণ শিক্ষক আব্দুল কুদ্দুস মিয়া বলেন, “এই ক্লিনিকটা গ্রামের অনেক মানুষের ভরসা। কিন্তু এখন সেটা ভরসা নয়, বিরক্তির জায়গা হয়ে গেছে। আমরা চাই—সরকার এটার সঠিক তদন্ত করুক।”
পানাগাড়ী কমিউনিটি ক্লিনিকের উদাসীনতা শুধু একটি স্বাস্থ্যকেন্দ্রের অনিয়ম নয়; এটি গ্রামীণ স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার বাস্তব চিত্রের প্রতিচ্ছবি। প্রশাসনের নিয়মিত তদারকি ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত না হলে, এই অনিয়ম থেকে বেরিয়ে আসা কঠিন। এখন সময় এসেছে—“তালা নয়, সেবা চাই” এই দাবিটি বাস্তবায়নের।
Comments