Image description

ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট উপজেলার শাকুয়াই ইউনিয়নের বালিজুড়ি গ্রামের বুক চিরে বয়ে চলা কংশনদ একসময় ছিল এই অঞ্চলের জীবনরেখা। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই নদী এখন পরিণত হয়েছে ধ্বংসের প্রতীক হিসেবে। অব্যাহত ভাঙনের ফলে বদলে গেছে নদীর গতিপথ, মানচিত্র এবং মানুষের জীবনযাত্রা।

একসময় ভারতের ভোগাই ও খড়িয়া নদীর মাধ্যমে ব্রহ্মপুত্রের সঙ্গে সংযুক্ত ছিল কংশনদ। এখন সেই সংযোগ ও প্রবাহ হারিয়ে গেছে, হারিয়েছে নদীর পুরনো রূপ ও ঐতিহ্য। নব্বইয়ের দশক থেকে শুরু হওয়া ভয়াবহ ভাঙনে বালিজুড়ি গ্রামের প্রায় তিনশ’ ফুট জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে।

স্থানীয় গ্রাম পুলিশ নিতাই চন্দ্র দাস বলেন, “আমাদের পৈতৃক জমির প্রায় ৭৬ শতাংশ কংশনদে চলে গেছে। ওপারে এখন যে জমি দেখা যায়, সেটা আসলে আমাদের হারানো পটভূমি।”

বালিজুড়ির ৮নং ওয়ার্ডে সরকারি খাল দখলের কারণে অন্তত ২৬টি পরিবার তাদের ঘরবাড়ি হারিয়ে স্থানান্তরিত হয়েছে। আন্ধার পার এলাকায় অবৈধ ফিশারি ও গোহুলা বেড়িবাঁধের কারণে পচা মাছের দুর্গন্ধে অনেকে স্থানান্তরে বাধ্য হয়েছেন।

একসময় ফুলপুর উপজেলার বাঁশতলা পর্যন্ত প্রবাহিত কংশনদের স্রোত এখন হালুয়াঘাটের বালিজুড়ি সীমানায় এসে ঠেকেছে। ডেফুলিয়া-বাঁশতলা এলাকায় ফেরিঘাটে একসময় মাত্র ১০ পয়সায় পারাপার করা যেত, এখন গুদারাঘাটে সেই ভাড়া ১০ টাকা। বর্তমানে এ ফেরিঘাটও হালুয়াঘাটের নিয়ন্ত্রণে।

নদীর ওপারে জেগে ওঠা নতুন চরে স্থানীয়রা সরিষা, বাদাম, খিরা, মিষ্টি কুমড়া ও বুড় ধানের চাষ শুরু করেছেন। নদী যেখানে কেড়ে নিয়েছে, সেখানেই মানুষ আশার বীজ বুনছেন।

কংশনদ তাই শুধু ধ্বংসের গল্প নয়, এটি সংগ্রাম ও অভিযোজনের প্রতীকও বটে। বালিজুড়ির প্রবীণ বাসিন্দারা আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, “একসময় এই নদী ছিল আমাদের জীবন, এখন সেটাই মৃত্যুভয়। ধানের ক্ষেত, বাগান, ঘর—সব নদীতে চলে গেছে।”

ডেফুলিয়া গুদারাঘাটের প্রবীণ মাঝি বিথু মিয়া বলেন, “একসময় এই নদী ফুলপুরের প্রাণ ছিল, এখন হালুয়াঘাটের মানুষের দুঃস্বপ্ন।” প্রতি বছর ভাদ্র-আশ্বিন মাসে উত্তাল জোয়ারে নদী গ্রাস করছে ঘরবাড়ি, জমি ও স্মৃতি।

১৯৫২ সালে ইউনিয়নের ভাইস চেয়ারম্যান ইমাদ খাঁ ও ১৯৬৮ সালে চেয়ারম্যান সৈয়দ সাহেবের সময় ফুলপুরের বাতিকুড়া গ্রামে মাত্র পাঁচটি পরিবার ছিল। এখন সেখানে ১০ থেকে ১৫টি পরিবার বসবাস করছে—যারা কংশনদের ভাঙনে নতুন আশ্রয় ও জীবিকা খুঁজে পেয়েছে।

স্থানীয়দের অভিযোগ, সরকারি খাল দখল, অবৈধ ফিশারি ও বেড়িবাঁধের কারণে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, যা পরিবেশ ও সামাজিক সংকট সৃষ্টি করছে। তারা অবিলম্বে স্থায়ী তীররক্ষা বাঁধ, পুনর্বাসন এবং কার্যকর নদী ব্যবস্থাপনার দাবি জানিয়েছেন।

কংশনদ শুধু একটি নদী নয়—এটি সংগ্রাম, অভিযোজন ও নতুন জীবনের নীরব সাক্ষ্য। নদীর একপাশে ধ্বংস হলেও অন্যপাশে জন্ম নিচ্ছে নতুন সম্ভাবনা। কিন্তু এই সম্ভাবনাকে টিকিয়ে রাখতে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে কংশনদের ভাঙন একদিন মানচিত্র থেকেই মুছে দিতে পারে হালুয়াঘাটের বালিজুড়িকে।