জামালগঞ্জে গ্রাম আদালতে জনপ্রিয় ভীমখালী ইউনিয়ন পরিষদ
মামলা বা আদালত শব্দ দুটি শুনলেই প্রথম মনে পড়ে বিচার পাওয়ার দীর্ঘ সময়, অর্থ খরচ ও অপেক্ষার কথা। মামলা জট আর দীর্ঘ সময় চলমান হওয়ার কারণে অনেকই বিচার পেতে শরণাপন্ন হয় না মামলা দায়েরে। পাশাপাশি মামলা চালাতে প্রয়োজন হয় অর্থের। যা গ্রামীণ জনপদের অনেকের সম্ভব হয় না।
জামালগঞ্জে গ্রামীণ জনপদের নিম্ন আয়ের মানুষের সঠিক বিচার প্রাপ্তিতে আশার আলো জাগিয়েছে ভিন্ন ধর্মী এক আদালতের বিচার ব্যবস্থা। সেই ভিন্ন ধর্মী আদালত হলো গ্রাম আদালত। নামের সাথেই কার্যকারিতা প্রকাশ পায়। গ্রাম গঞ্জের ছোট ছোট দেওয়ানী ও ফৌজদারি মামলা নিষ্পত্তির জন্য সারা দেশে ইউনিয়ন পরিষদের আওতায় গঠিত হয়েছে এই আদালত।
২০০৬ সালের গ্রাম আদালত আইন অনুযায়ী ইউনিয়ন পরিষদে ৩ লক্ষ টাকা মূল্যমানের দেওয়ানী ও ফৌজদারি মামলা নিষ্পত্তির জন্য পরিষদে যে আদালত বসে সে আদালতকে বলে গ্রাম আদালত। এই আদালতে গ্রামের অসহায় দরিদ্র মানুষের নানা বিষয়ে সুবিচার পাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে সরকার।
ইউনিয়ন পরিষদে দেওয়ানী মামলায় ২০ টাকা ও ফৌজদারি মামলায় ১০ টাকা জমা দিয়ে মামলা দায়ের করা যায়। এই আদালতে বিচার পাওয়ার জন্য কোন আইনজীবী না থাকায় বাদী বিবাদীর খরচের সম্মুখীন হতে হয় না। পড়তে হয় না বিচার প্রাপ্তিতে সময়ের ভোগান্তিতে।
স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান, সদস্য ও গণ্যমান্য বিচারকের উপস্থিতিতে বসে এই আদালত। এই আদালতে বিচারকের সংখ্যা থাকে ৫ জন। আর বাদী বিবাদীর পক্ষে থাকে ২ জন করে। এর মধ্যে ১ জন থাকতে হয় ইউপি সদস্য। স্থানীয় বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের উপস্থিতিতে গ্রাম আদালতে বিচার কার্য পরিচালিত হয় বলে সুযোগ থাকে না মিথ্যার আশ্রয়ের।
দেশের দরিদ্র মানুষের অধিকার নিশ্চিত করতে ২০০৬ সালে অধ্যাদেশের মাধ্যমে গ্রাম আদালত প্রতিষ্ঠা করে সরকার। তখন থেকে জামালগঞ্জের ৬ টি ইউনিয়নে শুরু হয় গ্রাম আদালতের কার্যক্রম। প্রথম দিকে তেমন জনপ্রিয়তা না থাকলেও সময়ের ব্যবধানে উপজেলার প্রতিটি ইউনিয়নে বাড়ছে গ্রাম আদালতের জনপ্রিয়তা। বিশেষ করে হাওরাঞ্চলের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের মাঝে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে এই আদালত। তার মধ্যে চমক দেখিয়েছে ভীমখালী ইউনিয়ন পরিষদ।
উপজেলার ৬ টি ইউনিয়নের মধ্যে ভীমখালী ইউনিয়নে গত জানুয়ারি থেকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত মামলা হয়েছে ৮৬ টি, এর মধ্যে দেওয়ানী ৩১ টি ফৌজদারি ৫৫। নিষ্পত্তি হয়েছে ৬১ টি।
ভীমখালী ইউনিয়নের নোয়াগাও গ্রামের গিয়াস উদ্দিনের স্ত্রী গোলবাহার বেগম বলেন, ‘আমি ভীমখালী ইউনিয়ন পরিষদে গ্রাম আদালত ৪০৬, ৪২০ ধারা একটি প্রতারণার অভিযোগ করি। মামলার শুনানিন্তে ১৫ দিনের মধ্যে বিবাদীদের নিকট থেকে ৭৫ হাজার টাকা আদায় করে দেওয়া হয়েছে। অভিযোগ দাখিলের পর স্থানীয় চেয়ারম্যান ও গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নিয়ে গঠন করা আদালতে বিচার করা হয়। এতে আমাদের দুই পক্ষের কারোরেই কোন আইনজীবী বা অর্থ খরচ হয় নি। অথচ আদালতে মামলা করে অর্থ খরচ ও বিচার সমাপ্তির দীর্ঘ সময় লাগতো।’
একই কথা বলেন বিবাদী নুর আলম। তিনি বলেন, ‘নিজেরা চেষ্টা করে যে বিষয়টি দীর্ঘ দিন সমাধান করতে পারিনি গ্রাম আদালতের সেই বিচারে সহজেই আমার সমাধানে পৌঁছেছি।
জামালগঞ্জ সদর ইউনিয়নের তেলিয়া বসুন্ধরা গ্রামের বাসিন্দা শিক্ষক সানা কুমার দাস জানান, আমার ভীমখালী ইউনিয়নের এক ব্যাক্তির বিরুদ্ধে প্রতারণার মামলায় ভীমখালী ইউনিয়ন পরিষদে মামলা দায়ের করলে ২০ দিনের মধ্যে বিবাদীর কাছ থেকে আদায় করা করার রায় হয়েছে। অর্ধেক টাকা পরিশোধ হয়েছে বাকি টাকা কিস্তিতে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। বিষয়টি সমাধান করে দুই পক্ষকে হাত মিলিয়ে বন্ধুত্ব করিয়ে দেওয়া হয়েছে। এতে আমরা উভয় পক্ষই খুশি।
আরও জানা যায়, বিগত ২০২৪ সালের জুন মাসের ৫ তারিখে চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের আদালত সুনামগঞ্জ থেকে ভীমখালী ইউনিয়নের একটি আলোচিত মামলা বিচারের জন্য ভীমখালী ইউনিয়ন পরিষদ গ্রাম আদালতে প্রেরণ করা হয়। উক্ত মামলায় শুনানী শেষে প্রতিবাদীগণের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তাদেরকে ১৫ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ আদেশ দেওয়া হয়। প্রতিবাদীগণ ক্ষতিপূরণ দিতে অস্বীকৃতি জানালে ইউনিয়ন পরিষদ উপজেলা নির্বাহী অফিস কার্যালয়ে সার্টিফিকেট মামলা রুজু করা হয়। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মুশফিকীন নুর প্রতিবাদী পক্ষের নিকট থেকে ১৫ হাজার টাকা আদায় করে ভীমখালী ইউনিয়ন পরিষদে প্রেরণের মাধ্যমে গ্রাম আদালতের আদেশ বাস্তবায়ন করেন।
গত ৭ ই ডিসেম্বর রোববার সরজমিনে ভীমখালী ইউনিয়ন পরিষদে গিয়ে দেখা যায়, অসংখ্য বাদি-বিবাদি, সাক্ষী গ্রাম আদালতের শালিশীগণের আনাগোনা। তার মধ্যে কথা হয় পার্শ্ববর্তী শান্তিগঞ্জ উপজেলার জয়কলস ইউনিয়নের নাসিমা বেগম নামের এক আবেদনকারীর সাথে। তিনি ভীমখালী ইউনিয়ন পরিষদের গ্রাম আদালতের কার্যক্রমে একজন বিচার প্রার্থী। তিনি সন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, এই আদালতে ১০ টাকা জমা দিয়ে সন্তোষজনক বিচার পেয়েছি।
তিনি আরও জানান, ইউনিয়ন পরিষদে গ্রাম আদালতের এজলাস না থাকায় চেয়ারম্যানের কক্ষে আদালত পরিচালনা করা হয়। এতে উভয় পক্ষের লোকজনের জায়গার সংকুলান থাকায় অসুবিধা হয়। তাই এজলাস সহ গ্রাম আদালতের একটি কক্ষ সরকারি ভাবে করে দিলে আদালতের কার্যক্রম আরো বেগবান হবে।
ভীমখালী ইউনিয়ন পরিষদের প্রশাসনিক কর্মকর্তা অজিত কুমার রায় বলেন, ইউনিয়নের ছোট খাটো বিষয় চুরি, জমি সংক্রান্ত বিরোধ, মারামারি, অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ নিয়ে এই আদালতে বেশিরভাগ অভিযোগ আসে। পরে গ্রাম আদালতের অভিযোগগুলো পরিষদে খুব সহজ ও সুন্দরভাবে অভিযোগের বিষয়টি সমাধান করা হয়। গ্রাম আদালতে কোন খরচ না হওয়ায় বাদি-বিবাদি উভয় পক্ষই খুশি থাকে।
বাদি চেয়ারম্যান বরাবরে অভিযোগ করলে পরবর্তীতে নোটিশের মাধ্যমে নির্ধারিত তারিখে বাদি-বিবাদিকে হাজির করা হয়। পরে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানকে সভাপতি করে ৫ সদস্যদের একটি বোর্ড গঠন করা হয়। বাদি ও বিবাদির একজন করে সংশ্লিষ্ট ইউপি সদস্য ও একজন করে গণ্যমান্য ব্যক্তি নিয়ে আদালত পরিচালনা করা হয়। গ্রাম আদালত সফল হওয়ার অন্যতম শর্ত হচ্ছে পরিষদবর্গের নিরেপক্ষতা। ভীমখালী ইউনিয়ন পরিষদের গ্রাম আদালতে পরিষদ নিরেপক্ষ থাকার কারণে সফলতা পেয়েছে।
ভীমখালী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মো. আখতারুজ্জামান তালুকদার বলেন, ‘উপজেলার সকল ইউনিয়নে গ্রাম আদালত রয়েছে। গ্রামাঞ্চলের মানুষেরা যখন তাদের ছোট খাটো বিভিন্ন বিষয়ে সমস্যা লেনদেন সংক্রান্ত, জমি জমা সংক্রান্ত সমস্যা সহ বিভিন্ন অভিযোগ নিয়ে আমাদের কাছে আসে। আমরা দ্রুতই সেটির সমাধান দেওয়ার চেষ্টা করি।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমার ইউনিয়নে প্রতি রোববার গ্রাম আদালত বসে। সেখানে আমরা দুই পক্ষ থেকে অভিযোগ শুনে তারপর গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সাথে পরামর্শ করে সমাধানের চেষ্টা করা হয়। ফলে গ্রাম আদালতে মানুষ সহজেই সমাধান পায়। এখানে উকিল রাখতে হয় না। যার কারণে কোন টাকা পয়সা খরচ হয় না। এই কারণে গ্রাম আদালতের উপর সাধরাণ মানুষের আস্থা বেড়েছে।’
গ্রাম আদালতে নিষ্পত্তি হওয়ার যোগ্য কোন মামলা চিফ জুডিশিয়াল আদালতে গেলেও আদালত তা আবার গ্রাম আদালতে পাঠিয়ে দেয়। সেগুলো নিষ্পত্তি করে আবার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট প্রতিবেদন পাঠাতে হয়। গ্রাম আদালতের মাধ্যমে খুব সহজেই গ্রামের মানুষের সমস্যা সমাধান করা যায়।
এব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মুশফিকীন নুর বলেন, ‘উপজেলার ৬ টি ইউনিয়নেই গ্রাম আদালত রয়েছে। প্রতি মাসেই তারা এই আদালতের রিপোর্ট জমা দেয়। আমরা সেই রিপোর্ট স্থানীয় সরকারের উপ-পরিচালক বরাবরে প্রেরণ করি। তাতে কে ভাল বিচার করছে, কে খারাপ বিচার করছে সেগুলো মূল্যায়ন করা হয়।’
তিনি বলেন, ‘গ্রাম আদালতে কাউকে জেল দেওয়া হয় না, শুধু জরিমানা করা হয়। জরিমানা আদায় না করলে পরবর্তীতে কোটে যাওয়া হয়। গ্রাম আদালতে বিচার হওয়ায় বিচার প্রার্থীর কোটে মামলা লড়ার যে খরচ সেটি যেমন কমে যায় তেমনি আদালতের উপরও চাপ কমে যায়।’
তিনি আরও বলেন, ‘স্থানীয় বিভিন্ন ছোট খাটো সমস্যা সমাধানে থানা প্রশাসনকে অনুরোধ করবো তারা যেন স্ব স্ব ইউনিয়নের গ্রাম আদালতে পাঠিয়ে দেয়। তাহলে গ্রাম আদালতের কার্যক্রম আরো গতিশীলতা পাবে। এছাড়াও গ্রাম আদালত সক্রিয় থাকায় বিভিন্ন এলাকায় প্রভাবশালী ব্যক্তিদের শালিসি বিচারের প্রবণতা কমে আসবে।’




Comments