Image description

উপমহাদেশের নারী জাগরণের অগ্রদূত মহিয়সী নারী বেগম রোকেয়ার ১৪৫ তম জন্মবার্ষিকী এবং ৯৩ তম মৃত্যুবার্ষিকী (৯ ডিসেম্বর) পালিত হয়েছে । পুরুষতান্ত্রিক সমাজের শিকল ভেঙ্গে অবিভক্ত বাংলায় তিনিই প্রথম নারী যুক্তির মাধ্যমে বুঝিয়েছিলেন, কেন পুরুষের পাশাপাশি সমাজ গঠনে নারীদেরও ভূমিকা রাখা জরুরি। তাঁর লেখা পড়ে আজও নারীরা অনুপ্রাণিত হন। নতুনভাবে বেঁচে থাকার শক্তি সঞ্চার করেন। নিজের পায়ে দাঁড়ানোর স্পৃহা দেখান।

বেগম রোকেয়া ১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর মিঠাপুকুর উপজেলার পায়রাবন্দ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।ধ্বংসপ্রায় বাড়ির চার দেয়ালের মধ্যেই ধর্মান্ধ সমাজের বিরুদ্ধে লড়াই করে বিশ্বসভায় অনন্য স্থান করে নিয়েছিলেন রোকেয়া।

২০০৯ সালের ৯ ডিসেম্বর রোকেয়া দিবসের মেলার আলোচনা সভায় তার ভাতিজি রনজিনা সাবের দাবি তোলেন বেগম রোকেয়ার দেহাবশেষ কলকাতা থেকে ফিরিয়ে আনার। রংপুরের তৎকালীন জেলা প্রশাসক বিএম এনামুল হক দাবিটির প্রতি একাত্মতা ঘোষণা করে উদ্যোগ নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। 

২০১০ সালে একই স্থানে বিএম এনামুল হক বলেছিলেন, রোকেয়ার দেহাবশেষ পায়রাবন্দে আনার ব্যাপারে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন দফতরে আবেদন করা হয়েছে। ২০১১ সালের রোকেয়া দিবসের আগে তার দেহাবশেষ পায়রাবন্দে আসবে। 

এ ঘোষণায় সেদিন পায়রাবন্দবাসী আনন্দিত হয়েছিল। কিন্তু পেরিয়ে গেল ১৫ বছর। এ ব্যাপারে আর কোনো উদ্যোগ নেয়নি জেলা প্রশাসন। পরে প্রতিশ্রুত এই ঘোষণার বাস্তবায়নের দাবিতে বিভিন্ন সময়ে একাধিক নারী সংগঠন সভা, সিম্পোজিয়াম, গোলটেবিল বৈঠকসহ নানা কর্মসূচি পালন করলেও কিছুই হয়নি।

প্রতিবছরই রোকেয়া দিবস এলে রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার পায়রাবন্দসহ নানা স্থানে বেগম রোকেয়াকে স্মরণ করার হিড়িক পড়ে যায়। দিবস চলে গেলেই রোকেয়ার কথা সবাই ভুলে যায়। এখনো পায়রাবন্দে বেগম রোকেয়ার জন্মভিটা অন্ধকারে নিমজ্জিত। রোকেয়া লড়াই করেছিলেন নারীদের শিক্ষার জন্য,লিখেছিলেন বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে। কিন্তু এখনো তার নিজ জন্মভূমিতেই ঠেকানো যায়নি বাল্যবিবাহ। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অভাবে পায়রাবন্দ ইউনিয়নের অভিরামনুরপুর এবং লহনী গ্রামের শিশুরা এখনো হেঁটে যায় ৩ কিঃমিঃ পথ। 

পায়রাবন্দ বেগম রোকেয়া স্মৃতি গার্লস স্কুল এন্ড কলেজের অধ্যক্ষ মাহেদুল আলম জানান, মাধ্যমিকের গন্ডি না পেরোতেই তার জন্মভূমি পায়রাবন্দে ১০ শতাংশ শিক্ষার্থী বাল্যবিবাহের কারণে ঝড়ে পড়ছে। উচ্চ মাধ্যমিকের গণ্ডি না পেরোতেই বাল্যবিবাহের কারণে ঝড়ে পড়ছে ৩০ শতাংশ শিক্ষার্থী। এযেনো বাতির নিচেই অন্ধকার। নিজ জন্মভূমিতেই বাস্তবায়িত হয়নি রোকেয়ার স্বপ্ন। আমরা অনেক চেষ্টার পরেও বাল্যবিবাহ ঠেকাতে পারছি নাহ।

করোনাকালীন সময় থেকেই সকল প্রকার কার্যক্রম বন্ধ ছিলো বেগম রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্রে। নামমাত্র অফিস করতো সেখানে কর্মরত কর্মকর্তা কর্মচারীরা। অবশেষে সেই অচলাবস্থা শেষে আজ স্মৃতিকেন্দ্রটি একীভূত হবে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে। 

বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ডঃ মোঃ শওকাত আলী জানান, আজ আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলা একাডেমির সঙ্গে একীভূতকরণের চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে। স্মৃতিকেন্দ্রটিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা গবেষণা ও অধ্যয়ন করবে। উন্মুক্ত হবে রোকেয়া চর্চার নতুন দ্বার।

বেগম রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্র সূত্রে জানা যায়, ১৯৯৭ সালের ২৮ জুন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বেগম রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্রের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের পৃষ্ঠপোষকতায় ৩ কোটি ৭৮ লাখ ৭৯ হাজার টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত করে বাংলা একাডেমি।

২০০১ সালের ১ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৩ দশমিক ১৫ একর ভূমির ওপর নির্মিত আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সংবলিত স্মৃতিকেন্দ্রটি উদ্বোধন করেন। স্মৃতিকেন্দ্রটিতে রয়েছে ২শ ৬০ আসনবিশিষ্ট একটি আধুনিক মিলনায়তন, ১শ আসনবিশিষ্ট একটি সেমিনার কক্ষ, ১০ হাজার পুস্তক ধারণক্ষমতা সম্পন্ন লাইব্রেরি, ৪ হাজার বিভিন্ন বইপত্র-পত্রিকা, গবেষণাকেন্দ্র, সংগ্রহশালা, ২৫টি সেলাই মেশিনসহ একটি প্রশিক্ষণকেন্দ্র, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অফিস, বেগম রোকেয়ার ভাস্কর্য ও উপ-পরিচালকসহ কর্মচারীদের আবাসন ব্যবস্থা। বাংলা একাডেমির আওতাভুক্ত এই স্মৃতিকেন্দ্রটিতে দীর্ঘদিন থেকে কোন দৃশ্যমান কার্যক্রম চালু নেই।

বেগম রোকেয়ার বাবা জহীরুদ্দিন মোহাম্মদ আবু আলী হায়দার সাবের পায়রাবন্দের শেষ জমিদার ছিলেন। ১৯১৩ সালে তার মৃত্যুর পর তার সাড়ে ৩শ বিঘা জমিও ধীরে ধীরে দখলদার ও স্থানীয় প্রভাবশালীদের দখলে চলে যায়। এমনকি পারিবারিক কবরস্থানটিও এখন প্রভাবশালীদের দখলে। এ নিয়ে ক্ষোভ রয়েছে রোকেয়া পরিবার, স্বজন ও অনুরাগীদের। রোকেয়া পরিবারের জমি উদ্ধারে উদ্যোগ নেওয়া হয় ২০১২ সালে। ওই বছরের ২২ মার্চ ‘হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ’ নামের একটি সংগঠনের হয়ে হাইকোর্টে একটি রিট করেন সুপ্রিমকোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনজিল মোরসেদ। সরকারি সহযোগিতা না থাকায় গেলো ১৩ বছরেও আলোর মুখ দেখেনি বেগম রোকেয়ার বাস্তুভিটা উদ্ধার মামলার কার্যক্রম।

বেগম রোকেয়া স্মৃতি সংসদের সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম দুলাল বলেন, রোকেয়ার বাবা মারা যাওয়ার পর তার পরিবার ও স্বজনরা এই জায়গা জমির প্রতি তাকাননি। এই অবস্থায় সিএসের (৪০ সালের রেকর্ড) সময় কিছু ভূমিদস্যু রোকেয়ার জমিগুলো নিজ নামে রেকর্ড করে নেয়। আজ পর্যন্ত তারা ওই জমি ভোগদখল করে খাচ্ছে। 

তিনি আরও বলেন, তখন (৪০ সালের রেকর্ড) রোকেয়ার ৪ ভাই-বোন বেঁচে ছিলেন। আইন অনুযায়ী, তাদের নামে জমিগুলো রেকর্ড হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু হয়নি। এ ক্ষেত্রে তৎকালীন অসাধু কিছু ভূমি কর্মকর্তা জড়িত বলে আমরা মনে করি। এসব জমি উদ্ধারে একটি মামলা হয়েছে, কিন্তু অগ্রগতি নেই।