নীরবে কাটল বীরাঙ্গনা গুরুদাসী মাসির মৃত্যুবার্ষিকী: ভিক্ষার লাঠিই ছিল যার স্বাধীনতার অর্জন
‘‘বাংলাদেশ স্বাধীন কইরা কী পাইলাম? পাইলাম একখান লাঠি আর তোদের পিঠে বাড়ি দিয়া বলি দশটা টাহা দে। কিন্তু যারা আমার স্বামী-পোলাপান মারিল, তোরা আজও তাদের বিচার করতে পারলি নে?’’
মস্তিষ্কবিকৃত অবস্থায় জীবদ্দশায় এভাবেই নিজের ক্ষোভ প্রকাশ করতেন বীরাঙ্গনা গুরুদাসী মণ্ডল। একাত্তরে যিনি হারিয়েছিলেন স্বামী, সন্তান ও সম্ভ্রম; স্বাধীন দেশে তার জুটেছিল কেবল অবহেলা, লাঞ্ছনা আর ভিক্ষার থালা। গত ৭ ডিসেম্বর ছিল এই মহীয়সী নারীর ১৬তম মৃত্যুবার্ষিকী। দিনটি কেটেছে অনেকটা নীরবে-নিভৃতে, যেমন অবহেলায় কেটেছিল তার জীবনের শেষ দিনগুলো।
পাইকগাছা উপজেলার কালীনগর গ্রামের হাসিখুশি গৃহবধূ ছিলেন গুরুদাসী। স্বামী গুরুপদ মণ্ডল ছিলেন দর্জি। পাঁচ সন্তান নিয়ে ছিল সুখের সংসার। একাত্তরের এপ্রিলে যুদ্ধের ভয়াবহতায় ভারতে পালানোর চেষ্টা করেও ‘সাধারণ ক্ষমা’র ঘোষণায় বিশ্বাস করে ফিরে এসেছিলেন গ্রামে। কিন্তু তাদের গ্রাম বারো আড়িয়া তখন রাজাকারদের মৃত্যুপুরী।
একদিন রাজাকাররা ধরে নিয়ে যায় স্বামী গুরুপদকে। পরদিন চোখের সামনে স্বামীকে দিয়ে নিজের কবর খোঁড়ানো হয়, এরপর গুলি করে হত্যা করা হয়। রেহাই মেলেনি সন্তানদেরও। ছেলে অংশুপতি, খোকন ও মেয়ে অঞ্জলিকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে এবং কোলের শিশু পারুলকে মাটিতে আছড়ে হত্যা করে পাষণ্ডরা। এরপর গুরুদাসী নিক্ষিপ্ত হন রাজাকার ক্যাম্পের অন্ধকার ঘরে। মাসের পর মাস চলে তার ওপর পৈশাচিক নির্যাতন।
পাইকগাছার তৎকালীন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার স ম বাবর আলীর ভাষ্যমতে, ‘গুরুদাসী তখন পশুর চেয়েও অধম আচরণ পেয়েছিলেন। দিনের পর দিন তাকে ধর্ষণ ও নির্যাতন করা হয়েছে।’
স্বাধীনতার পর পাবনা মানসিক হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হলেও স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেননি গুরুদাসী। কপিলমুনিতে সরকারি জমিতে একটি ছোট ঘরে ঠাঁই হয় তার। কিন্তু জীবিকার জন্য হাতে তুলে নিতে হয় ভিক্ষার থালা আর বাঁশের কঞ্চি। শহরের অলিগলি ঘুরে কঞ্চির টোকা দিয়ে বলতেন, ‘‘দশটা টাহা দে… খাব কি?’’
মুক্তিযোদ্ধারা তাকে সম্মান করে ‘মা’ ডাকলেও সমাজের নিষ্ঠুরতা থামেনি। পথশিশুরা তাকে ‘রাজাকারের বউ’ বলে উত্যক্ত করত। তখন তিনি হাহাকার করে বলতেন, ‘‘স্বামী-ছেলেমেয়া সব মাইরা আমারে ধরছে- আমি রাজাকারের বউ?’’
২০০৮ সালের ৭ ডিসেম্বর রাতে বিনা চিকিৎসায়, জরাজীর্ণ ঘরে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন গুরুদাসী মাসি। মৃত্যুর পর ২০১৬ সালের ১২ অক্টোবর মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় ৪১ জন বীরাঙ্গনাকে মুক্তিযোদ্ধার মর্যাদা দেয়, যেখানে গুরুদাসীর নামও ছিল। কিন্তু সেই সম্মান দেখার জন্য তিনি আর বেঁচে ছিলেন না। মৃত্যুর ৮ বছর পর আসে এই রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি।
সরেজমিনে দেখা যায়, বীরাঙ্গনা গুরুদাসীর শেষ স্মৃতিচিহ্নটুকুও আজ বিপন্ন। কপিলমুনিতে তার থাকার ঘরটি এখন নেশাখোরদের আড্ডাস্থলে পরিণত হয়েছে। আঙিনাজুড়ে মলমূত্র আর আবর্জনা। স্মৃতি রক্ষার সাইনবোর্ডটিও উধাও। গত ১৫ বছরেও প্রস্তাবিত ‘স্মৃতি জাদুঘর’ বাস্তবায়িত হয়নি।
স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা ও সচেতন মহলের আক্ষেপ, আমরা একজন বীরাঙ্গনাকে জীবদ্দশায় সম্মান দিতে পারিনি, এমনকি মৃত্যুর পরও তার স্মৃতিটুকু রক্ষা করতে পারছি না। ইতিহাসের দায় মেটাতে অন্তত তার স্মৃতিচিহ্নটুকু সংরক্ষণ করা জরুরি।




Comments