জীবনযুদ্ধের হাতিয়ার ছুরি–বঁটি: মাছ কাটার আয়ে চলছে অর্ধশতাধিক পরিবার

বরিশালের ব্যস্ততম পোর্ট রোড বাজার। ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই জমে ওঠে মাছের বেচাকেনা। বাজারের একপাশে রয়েছে একটি ব্যতিক্রমী চিত্র, অর্ধ শতাধিক নারী-পুরুষ প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত মাছ কাটায় ব্যস্ত। ছুরি-দা হাতে, ছোট ছোট টুলে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা মাছ কাটেন তাঁরা। এই কাজই তাঁদের একমাত্র পেশা, জীবিকার অবলম্বন। মাছ কাটাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে এক নির্ভরশীল অর্থনৈতিক চক্র। প্রতিদিন এই শ্রমজীবী মানুষদের আয়ে চলে শত শত মানুষের ভাত কাপড়ের যোগান।
মো. রিপন শেখ। বয়স ৬২ ছুঁইছুঁই। ৩৭ বছর ধরে এই পেশার সাথে জড়িত। একটানা মাছ কাটছেন পোর্ট রোড বাজারে। এই পেশার ওপরই নির্ভর করে তাঁর পাঁচজনের সংসার। তিনি বলেন-"আগে বাজারে মাছ কাটার লোক ছিল মাত্র ১০ জন। এখন দাঁড়িয়েছে ৫০ জনে। আগে প্রতিদিন ১৫০০-২০০০ টাকা আয় হতো, এখন কোনো দিন তা ৪০০ টাকায়ও নামে আসে। তবু ছাড়েন নি এ পেশা,"
তিনি মাছ কাটার আয় দিয়েই সন্তানদের পড়াশোনা চালিয়েছেন, সংসার টেনেছেন, এমনকি কখনো কখনো ঋণ শোধও করেছেন।
বর্তমানে প্রতিদিন মাছ কাটার কাজ করে গড়ে ১০০০ থেকে ১৫০০ টাকা আয় করেন এই কর্মীরা। তবে মাছের আমদানি কম হলে কিংবা বৃষ্টির দিনে বাজার ফাঁকা থাকলে আয় কমে দাঁড়ায় ৫০০ টাকার নিচে।
"মাঝেমধ্যে দুই-তিন ঘণ্টা বসে থাকি, কোনো কাজ নাই। আবার হঠাৎ ভিড় বাড়লে কাজ সামলানো যায় না,"-জানালেন মাছ কাটা কর্মী শেফালী গোলদার।
একটা সময় মানুষ বাসায় গিয়ে নিজেরা মাছ কাটতেন। এখন অনেকেই বাজার থেকেই কাটা মাছ নিয়ে যান। এতে করে সময় বাঁচে, বাড়তি ঝামেলা কমে। এই পরিবর্তনের কারণে মাছ কাটার কাজের চাহিদা কিছুটা বেড়েছে, তবে একইসাথে বেড়েছে প্রতিযোগিতাও।
সৌরভ নামের এক ক্রেতা বলেন-"আগে মাছ কিনে বাসায় গিয়ে কাটতে অনেক ঝামেলা হতো। এখন বাজারেই কাটুনি আছে, সঙ্গে সঙ্গে টুকরা করে দেয়। এতে সময়ও বাঁচে, ঝামেলাও কমে। আমরাও খুশি।”
প্রবীণ মাছ কাটা কর্মী মো. কামরুল গাজী বলেন-"মানুষ সময় বাঁচাতে চায়, তাই আমরা আছি। কিন্তু এখন যারা কাজ করে, তাদের অনেকেই অদক্ষ—তাই মাঝে মাঝে কাজও কমে যায়,"
মাছ কাটার সময় হাত কেটে যাওয়া, পানিতে পা ভিজে চর্মরোগ হওয়া, মাছের আঁশ ও গন্ধে নানা ধরণের শারীরিক অসুবিধা হতেই থাকে। কিন্তু এসব শ্রমজীবী মানুষের নেই কোনো প্রশিক্ষণ, সুরক্ষা ব্যবস্থা বা স্বাস্থ্যসেবা।
হতাশা প্রকাশ করে অপর এক মাছ কাটুনি মো. বাহাদুর বলেন- "আমরা মাছ কাটির মানুষ। আমাদের দেখার কেউ নাই। কাজ থাকলে টাকা পাই, না থাকলে খালি হাতে ফিরি,"
বিশেষজ্ঞদের মতে, স্থানীয় সরকার ও এনজিওগুলো যদি এই মাছ কাটার পেশাকে প্রশিক্ষণভিত্তিক কর্মসংস্থান হিসেবে বিবেচনায় নেয়, তাহলে একদিকে দক্ষতা বাড়বে, অন্যদিকে আয়ও স্থিতিশীল হতে পারে। তাছাড়া মাছ কাটার জন্য উন্নত সরঞ্জাম সরবরাহ, স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিতকরণ এবং ক্ষুদ্র ঋণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
Comments