পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি ফেরাতে ২৫০ নতুন সেনা ক্যাম্পের প্রস্তাব

পার্বত্য চট্টগ্রামে ক্রমবর্ধমান অস্থিতিশীলতা ও সশস্ত্র সন্ত্রাসী কার্যক্রম মোকাবিলায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী অন্তত ২৫০টি নতুন সেনা ক্যাম্প স্থাপনের প্রস্তাব করেছে। সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ভারতীয় মদতপুষ্ট সশস্ত্র সংগঠন ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) অঞ্চলটিকে অস্থিতিশীল করতে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। চাঁদাবাজি, অপহরণ, হত্যাকাণ্ড এবং সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টির মতো কার্যক্রমে জড়িত এই সংগঠনটি বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ইউপিডিএফ-এর সন্ত্রাসী কার্যক্রম
নিরাপত্তা বাহিনীর তথ্যমতে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পলায়নের পর ভারত পার্বত্য চট্টগ্রামে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির মাধ্যমে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বকে হুমকির মুখে ফেলতে সক্রিয় হয়েছে। ইউপিডিএফ ভারতের মিজোরামে স্থাপিত ক্যাম্প থেকে অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ নিয়ে বাংলাদেশে নাশকতা চালাচ্ছে। গোয়েন্দা রিপোর্ট অনুযায়ী, গত এক বছরে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো পার্বত্য এলাকা থেকে প্রায় ৩৫০ কোটি টাকা চাঁদা তুলেছে, যার মধ্যে ইউপিডিএফ একাই তুলেছে ১০৪ কোটি টাকা। এই চাঁদা আদায়ের তালিকায় রয়েছে সাধারণ মানুষ, ব্যবসায়ী, কৃষক, যানবাহন, ঠিকাদার, কাঠ ও বাঁশ ব্যবসায়ী এবং অপহরণ। জেলাভিত্তিক হিসেবে রাঙামাটি থেকে ২৪৪ কোটি, খাগড়াছড়ি থেকে ৮৬ কোটি এবং বান্দরবান থেকে ২০ কোটি টাকা চাঁদা তোলা হয়েছে।
ইউপিডিএফ শুধু চাঁদাবাজিতেই সীমাবদ্ধ নয়, তারা অপহরণ ও হত্যাকাণ্ডের সঙ্গেও জড়িত। ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত তারা ৩৩২ জনকে অপহরণ করেছে, যার মধ্যে পাহাড়ি সম্প্রদায়ের সদস্যরাও রয়েছেন। সর্বশেষ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচ শিক্ষার্থীকে অপহরণের ঘটনা ঘটেছে। এই সময়ে তাদের হাতে ৮৯ জন নিহত হয়েছেন, যার মধ্যে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সদস্য এবং সেনাবাহিনীর ১৬ সদস্যও রয়েছেন।
নতুন সেনা ক্যাম্পের প্রয়োজনীয়তা
সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা জানান, ১৯৯৭ সালের শান্তিচুক্তির পর সেনা ক্যাম্পের সংখ্যা কমে যাওয়ায় সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো শক্তি সঞ্চয় করেছে। বর্তমানে খাগড়াছড়িতে ৯০, রাঙামাটিতে ৭০ এবং বান্দরবানে ৫০টি সেনা ক্যাম্প রয়েছে। তবে পাহাড়ের দুর্গম ভৌগোলিক অবস্থার কারণে এই সংখ্যা পর্যাপ্ত নয়। নতুন ২৫০টি ক্যাম্প স্থাপন করা হলে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া জানানো, অস্ত্রপ্রবাহ বন্ধ করা এবং চাঁদাবাজি ও অপহরণ রোধ সম্ভব হবে। সেনাবাহিনী মনে করে, এই ক্যাম্পগুলো সীমান্তবর্তী দুর্গম এলাকায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা এবং জাতীয় সার্বভৌমত্ব রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
একজন ব্রিগেড কমান্ডার বলেন, “ইউপিডিএফ এবং অন্যান্য সন্ত্রাসী গোষ্ঠী ভারতের মিজোরাম থেকে অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ নিয়ে পাহাড়ে হামলা চালাচ্ছে। সীমান্তবর্তী এলাকায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য অতিরিক্ত সেনা ক্যাম্প অপরিহার্য।” খাগড়াছড়ি জোনের একজন লেফটেন্যান্ট কর্নেল জানান, “মিথ্যা ধর্ষণের নাটক সাজিয়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টির চেষ্টা চলছে। এ ধরনের ষড়যন্ত্র ঠেকাতে দ্রুত সেনা উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে।”
হাসিনা সরকারের নীতি ও বর্তমান অবস্থান
সেনা সদরের তথ্যমতে, শেখ হাসিনার আমলে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর প্রতি নমনীয় নীতি গ্রহণ করা হতো, যার ফলে তারা রাজনৈতিক মদত ও প্রশাসনিক শৈথিল্যের সুযোগ নিয়ে শক্তিশালী হয়েছে। তবে বর্তমানে সেনাবাহিনীর নীতি হলো ‘নো কম্প্রোমাইজ’। অর্থাৎ, সন্ত্রাসীদের সঙ্গে কোনো আপস বা আলোচনা নয়, সরাসরি পদক্ষেপই একমাত্র পথ। একজন মেজর জানান, “ইউপিডিএফের চাঁদাবাজি ও হত্যাকাণ্ডের তথ্য আমাদের হাতে আছে। তারা ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার সহায়তায় চলছে। নতুন ক্যাম্পগুলো হলে আমরা এক ঘণ্টার মধ্যে যেকোনো স্থানে অভিযান চালাতে পারব।”
বিশেষজ্ঞদের মতামত
নিরাপত্তা বিশ্লেষক মোহাম্মদ এমদাদুল ইসলাম বলেন, “পার্বত্য চট্টগ্রামে সন্ত্রাসী তৎপরতা, চাঁদাবাজি, অপহরণ ও হত্যাকাণ্ড নতুন মাত্রা পেয়েছে। সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহারের পরিবর্তে আমাদের কৌশলগতভাবে এগিয়ে যাওয়া উচিত।” অধ্যাপক ড. শহীদুজ্জামান বলেন, “ইউপিডিএফ ও অন্যান্য গোষ্ঠী ভারতের মিজোরাম ও ত্রিপুরা থেকে অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। সীমান্তবর্তী এলাকায় দ্রুত প্রতিক্রিয়া ও কার্যকর নজরদারির জন্য ২৫০টি নতুন সেনা ক্যাম্প স্থাপন জরুরি।”
সেনাবাহিনীর প্রতিশ্রুতি
খাগড়াছড়িতে দায়িত্ব পালন করা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হাসান মাহমুদ বলেন, “নতুন সেনা ক্যাম্প স্থাপনের বিষয়টি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের এখতিয়ারভুক্ত। আমরা বর্তমান সম্পদ নিয়ে নজরদারি অব্যাহত রেখেছি। ইউপিডিএফ ধর্ষণের ঘটনাকে পুঁজি করে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টির চেষ্টা করছে। সেনাবাহিনী দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সর্বোচ্চ ভূমিকা পালন করবে।”
পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে এবং সন্ত্রাসী কার্যক্রম দমন করতে সেনাবাহিনীর এই উদ্যোগ গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
Comments