Image description

পাঁচ বছর আগে ভেঙে ফেলা হয় স্কুল ভবন। তখন থেকে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের রোদ-বৃষ্টি, ঝড়-তুফানেও পাঠদান দিতে প্রায় আধা কিলোমিটার দূরে একটি পুকুরের পাড়ের জমিতে চুক্তিভিত্তিতে ভাড়া নেওয়া হয় একটি টিনশেড ঘর। নতুন একটি ভবনের আশ্বাসে দীর্ঘ পাঁচ বছর ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের তিনকক্ষ বিশিষ্ট টিনশেড ঘরে পাঠদান দেওয়া হয়।

রোদ-গরমে ক্লাস করতে অতিষ্ঠ হয়ে অনেক শিক্ষার্থী স্কুলেও আসতে চান না। গত পাঁচ বছরের কমেছে শিক্ষার্থীর সংখ্যাও। ছোট-ছোট শ্রেণি কক্ষে পাঠদান দিতে চরম হিমশিম খেতে হয় শিক্ষকদের। এতে ব্যাহত হচ্ছে স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রম।

গত ৫ বছর ধরে এই দুঃখ যেন ঘোচে না চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার বারখাইন ইউনিয়নের দক্ষিণ তৈলারদ্বীপ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের স্কুলের ১৪৭ জন কোমলমতি শিক্ষার্থী ও ৬ জন নারী শিক্ষিকার। জায়গা সংকটের কারণে নিয়মিত অ্যাসেম্বলিও করতে হচ্ছে শ্রেণী কক্ষের ভেতরে।

রোববার (২৬ অক্টোম্বর) সকালে সরেজমিনে বিদ্যালয়টি ঘুরে দেখা গেছে, বিদ্যালয়ের নির্মাণাধীন ভবনের কাজ ফেলে রেখে চলে গেছে ওয়াহিদ কনস্ট্রাকশন নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। পুরাতন সেমিপাকা ভবন ভেঙ্গে পাইলিং করা লোহায় জং ধরেছে, পানিতে ডুবে পাইলিং করা পিলার গুলোও। চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ভবন নির্মাণের নানা যন্ত্রাংশ। পুরাতন স্কুলে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কক্ষটি রেখে সবই ভেঙে ফেলা হয়েছে। বর্তমানে বিদ্যালয় থেকে প্রায় আধা কিলোমিটার দূরে একটি পুকুরপাড়ের টিন সিটের ঘরের মধ্যে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করাচ্ছেন নারী শিক্ষিকারা। সেটিও পুকুরের দিকে হেলে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে  শ্রেণিকক্ষ সংকটে একটি বেঞ্চে বসতে হচ্ছে চার থেকে পাঁচজন শিক্ষার্থীকে। তাদের নিয়মিত অ্যাসেম্বলিও করতে হচ্ছে শ্রেণী কক্ষের ভেতরে। এতে ব্যাহত হচ্ছে পাঠদান কার্যক্রম।

স্থানীয় বাসিন্দা এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক মোহাম্মদ ইদ্রিছ আক্ষেপ প্রকাশ করে বলেন, বিদ্যালয়ের শ্রেনীকক্ষের অবস্থা ভালো না। যার কারণে বাচ্চারা স্কুলে যেতে চায় না। সরকার যদি নতুন ভবনের ব্যবস্থা না করে এ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমে যাবে।

বিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণীর শিক্ষার্থী ফাতেমা জোহরা, ইমরান হোসাইন তানভীর ও পঞ্চম শ্রেণীর মো. ফারাবি রহমান রাব্বি বলেন, পুরাতন ভবনই অনেক ভালো ছিল। ভবন না থাকায় আমাদের অনেক কষ্ট করে পাঠগ্রহণ করতে হচ্ছে। রোদের কারণে টিনের চালা খুবই গরম হয়। তাপে মনে হয় শরীর পুড়ে যাচ্ছে।

শিক্ষিকা রুনো আরা বেগম ও মনোয়ারা বেগম বেগম বলেন, ‘বর্ষা বা গ্রীস্মকালে সবচেয়ে বেশি কস্টে পড়তে হয় শিশুদের নিয়ে। অন্য স্কুলের শিক্ষার্থীদের চেয়ে আমাদের শিক্ষার্থীরা অনেক কিছু থেকে বঞ্চিত হচ্ছে ভবন আর খেলার মাঠ না থাকার কারণে। আমরা এটার প্রতিকার চাই।’

অভিভাবক ও স্থানীয়রা অভিযোগ করে বলেন, ঠিকাদার ও স্থানীয় একটি গ্রুপের সাথে কাজের ভাগাভাগির দর কষাকষিকে কেন্দ্র করে ভবন নির্মাণে নানান জটিলতা সৃষ্টি হলেও সংশ্লিষ্ট দপ্তর কার্যকরি কোন পদক্ষেপ নেননি। ইতিমধ্যে নির্মাণ সামগ্রীর মধ্যে লোহাসহ বিভিন্ন যন্ত্রাংশ নিয়ে যাচ্ছে যে যার ইচ্ছে মত।

বিদ্যালয় সূত্র জানায়, ২০২১ সালে ওয়ার্ড ব্যাংকের অর্থয়ানে (এমডিএফপি) প্রকল্পে ৫ কোটি টাকা ব্যয়ে দক্ষিণ তৈলারদ্বীপ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নতুন ভবন নির্মানের জন্য পূর্বের সেমিপাকা স্কুল ভবনটি ভেঙ্গে ফেলেন ঠিকাদার। এরপর আধা কিলোমিটার দূলে একটি পুকুর পাড়ে ২ বছরের চুক্তিভিত্তিক একটি টিনশেড ঘর ভাড়া নিয়ে শিক্ষা কার্যক্রম চলছে। এদিকে ঠিকাদার কাজ ফেলে পালিয়ে গেলে পরবর্তীতে টেন্ডার প্রক্রিয়াও বাতিল হয়ে যায়। আর বিদ্যালয়ের নতুন ভবন নির্মাণ প্রকল্পটিও ঝুলে থাকে। বিদ্যালয়ে নতুন ভবনের আশায় রোদ-বৃষ্টি, ঝড়-তুফানেও পাঠদান দিতে হয় টিনশেড ঘরে। যার ফলে দিনদিন শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমে যাচ্ছে। ছোট-ছোট শ্রেণি কক্ষে পাঠদান দিতে চরম হিমশিম খেতে হয় শিক্ষকদের। এই অবস্থায় কবে এ বিদ্যালয়ের নতুন ভবন নির্মাণ হবে তা নিয়ে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা। এনিয়ে শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবকদের মাঝে  হতাশা ও ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।

স্থানীয় যুবক আমিনুল হক, মোহাম্মদ সাকিব, মোহাম্মদ রিদোয়ান ও মোহাম্মদ সায়মন বলেন, ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান ২০২১ সালে বিদ্যালয়ের পুরাতন সেমিপাকা ভবন ভেঙ্গে পাইলিং কাজ শুরু করে। এলাকাবাসী মনে করেছিল দ্রুত বিদ্যালয়ের ভবন নির্মাণ কাজ শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু বছর খানেক পর ঠিকাদার উধাও হয়ে যায় আর বিভিন্ন নির্মাণ সামগ্রী গুলো এভাবে পড়ে থাকে। যেন দেখার কেউ নাই।

বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা জয়নাব বেগম বলেন, ‘ভবন না থাকায় শিক্ষার্থীদের নিয়ে আমরা বিপাকে পড়েছি। তাদের পাঠদানে সমস্যা হচ্ছে। আগের তুলনায় অনেক শিক্ষার্থীও কমে গেছে। আগে আমাদের দুই শতাধিক শিক্ষার্থী ছিল। এখন আছে মাত্র ১৪৭ জন। এছাড়াও নেই কোনো নিরাপত্তা প্রহরীও। আমার শিক্ষার্থীরা বঞ্চিত হচ্ছে তাদের মাল্টিমিডিয়া ক্লাস থেকেও। দামী কোনো জিনিসপত্র এই টিন সিটের কক্ষে রাখা যায় না চোরের ভয়ে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আগের পুরাতন ভবনই অনেক ভালো ছিল। এক বছরে কাজ শেষ করার কথা বলে ভবন  ভেঙে ৫ বছরেরও হয়নি নতুন ভবন। বিভিন্ন দপ্তরের একাধিক চিঠিসহ ঘুরেও কোনো প্রতিকার মিলেনি।’

আনোয়ারা উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) সানাউল্লাহ্ কাউছার বলেন, এমডিএসপি প্রকল্প থেকে বিদ্যালয়ের ভবন বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু দ্বীর্ঘদিন নির্মাণ কাজ শুরু না করায় শিক্ষার সার্বিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। এমতাবস্থায় জরুরি ভিত্তিতে একটা অস্থায়ী কক্ষ নির্মাণের জন্য এডুকেশন ইন ইমার্জেন্সি ফান্ড থেকে সহায়তার জন্য জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার মাধ্যমে আবেদন পাঠানো হয়েছে।

আনোয়ারা উপজেলা প্রকৌশলী জাহেদুল আলম চৌধুরী বলেন, ‘প্রকল্পটি বাতিল করায় বি স্ট্রিম প্রকল্পের আওতায় আরেকটি প্রকল্পের মাধ্যমে বিদ্যালয় ভবন নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করা হবে।’

আনোয়ারা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তাহমিনা আক্তার বলেন, ‘এই স্কুল ভবনটির জন্য নতুন করে বরাদ্দ দিতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।’